॥ আব্দুর রাজ্জাক রানা ॥
‘হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু-তায়ালা আনহু মৃত্যুশয্যায় একটি দীর্ঘ উইল লিখিয়েছিলেন। এতে তার পরবর্তী খলিফার জন্য কিছু দিকনির্দেশনা ছিল। এই উইলটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর সর্বশেষ অংশ : আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে যাদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রের অমুসলিম সংখ্যালঘু বা জিম্মিদের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে দিকনির্দেশনা প্রদান করছি। তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অবশ্যই কার্যকর করতে হবে পুরোপুরি; তাদের রক্ষা করার স্বার্থে আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে এবং তাদের ওপর যেন সামর্থ্যরে বাইরে কিছুতেই বোঝা চাপানো না হয়।’
হজরত উমর (রা.) তখন মৃত্যুশয্যায় যন্ত্রণাকাতর ছিলেন। তিনি ফজর নামাজের জামাতে ইমামতি করার সময় একজন অমুসলিম বিষ মেশানো ছোরা দিয়ে তাকে মারাত্মক আঘাত করেছিল। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। এটাও স্মরণে রাখা দরকার, তিনি ছিলেন বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি। এর বিস্তৃতি ছিল পারস্য থেকে মিসর পর্যন্ত। তার আমল কিংবা আমাদের এ যুগের শাসকদের কাছ থেকে আমরা প্রতিশোধ এবং ত্বরিত পদক্ষেপই আশা করতে পারতাম।
অপরদিকে আধুনিকতার আলোকে উদ্ভাসিত, আজকের শাসকেরা একই ধরনের পরিস্থিতিতে হত্যা চক্রান্তের নিছক সন্দেহের কারণেও বোমা ও মিসাইল বর্ষণ করতেন বৃষ্টির মতো। আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যদি খুব বেশি ক্ষমাশীল হয়ে থাকেন, তার কাছে প্রত্যাশিত হতো, ‘ভুলে যাও এবং ক্ষমা করে দাও’ নীতি অবলম্বনের প্রয়াস। সেটা গণ্য হতো মহত্ব হিসেবে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা এবং তাদের দেখাশোনা করার জন্য আদেশ দেয়া হবে, এমনটা আশা করা যেত কি?
আরো উল্লেখযোগ্য হলো, মুসলিম ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে নিছক স্বাভাবিক বা মামুলি ব্যাপার বলে বিবেচিত হতো সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে এই অসাধারণ পদক্ষেপ ও ভূমিকাকে। সবচেয়ে বড় কথা, ইসলামের খলিফা নিজেই এ ক্ষেত্রে ‘মডেল’ হয়ে উঠেছিলেন। খলিফা উমর (রা.) এর আমলে মুসলিম বাহিনী একের পর এক অঞ্চল জয় করে নিচ্ছিল আর তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার গ্যারান্টি দিয়ে একের পর এক আদেশ জারি করছিলেন লিখিতভাবে। এই যে নিয়ম বা আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো, তা মুসলিম বিশ্বজুড়ে কয়েক শতাব্দীজুড়ে অনুস্মরণ করা হয়েছিল।
অবশ্যই হজরত ওমর (রা.) শুধু সেটাই বাস্তবায়ন করছিলেন, যা তিনি শিখেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছ থেকে। এই শিক্ষা হলো, সংখ্যালঘুদের জীবন সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা ইসলামি রাষ্ট্রের ধর্মীয় দায়িত্ব।
হাদিসে আছে, কোনো মুসলমান যদি কোনো জিম্মি বা অমুসলিমের প্রতি অবিচার করে থাকে, তা হলে নবী করীম (সা.) নিজে আখেরাতে তার পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করবেন। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, ধর্মে নেই কোনো প্রকার জোর জবরদস্তি এবং মুসলমানদের ন্যায়বিচার করতে হবে বন্ধু ও শত্রু নির্বিশেষে সবার প্রতি।
এসব সুমহান শিক্ষার সুফল স্বরূপ মুসলমানরা এমন শাসন কায়েমে সফল হয়েছিল যে, ধর্মীয় সহনশীলতার এমন নজির স্থাপিত হয় যা সৃষ্টি করে সোনালি যুগ। অথচ তখনকার বিশ্ব এমন মহানুভবতার সাথে পরিচিত ছিল না। মুসলিম জাতির ইতিহাস (খ্রিস্ট জগতের) ‘ইনকুইজিশন’, নির্যাতন, দুষ্ট আত্মা তাড়ানোর নামে হত্যা এবং গণহত্যার দৃষ্টান্ত থেকে মুক্ত থাকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এসব অন্যায় কাজ অন্যান্য সভ্যতার ইতিহাসকে করেছিল কলুষিত। তদুপরি মুসলমানরা সংখ্যালঘুদের বাঁচিয়েছে তাদের ওপর অন্যদের হত্যা-নিপীড়ন থেকেও। মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের কবল থেকে ইহুদিদের রক্ষা করেছে। আর ইস্টার্ন চার্চেল অনুসারী খ্রিষ্টানদের বাঁচিয়েছে রোমান ক্যাথলিকদের হাত থেকে। স্পেনে উমাইয়া শাসনের সময়ে এবং বাগদাদে আব্বাসীয় বংশের রাজত্বকালে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ধর্মীয় স্বাধীনতা এত বেশি ভোগ করত, যা তারা নিজেরা পরস্পরকে কিংবা অন্য কাউকে দেয়নি। এই অনন্য সহিষ্ণুতা ইসলামি শিক্ষার মধ্যে প্রোথিত।
ইসলামের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা হচ্ছে, এই পার্থিব জীবন মানব জাতির জন্য একটি পরীক্ষা মাত্র। এখানে আমরা সে দু’টি পথের একটি বেছে নিতে পারি, যা জাহান্নাম কিংবা জান্নাতে আমাদের পৌঁছে দেবে। যুগে যুগে নবী-রাসূল আলাইহুমুস সালামকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এ সম্পর্কে জানাতে এবং কৃতকর্মের পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করে দিতে। মানুষকে ধরে ধরে জোর করে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে তাদের প্রেরণ করা হয়নি। মুসলমানদের কর্তব্যও এটাই। মানব জাতির সামনে ইসলামের বাণী অবিকৃতভাবে তুলে ধরতে হবে অবশ্যই। আকর্ষণীয় করার জন্য তারা এই বাণীতে পরিবর্তন আনতে পারে না, কিংবা এটা গ্রহণ করাতে কাউকে ভয় দেখানোর অধিকারও তারা রাখে না। ঈমানের ওপর ভিত্তি করে পরকালে মানুষ ফলাফল ভোগ করবে। কারণ সঠিক ঈমান বা বিশ্বাস ছাড়া সব সৎকাজই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। আর ঈমান হলো অন্তরের ব্যাপার। ঈমান কারো ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।
অমুসলিমরা ইসলামের এসব নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তবে ধর্মীয় সহনশীলতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অভিজ্ঞতা অন্যদের ঠিক বিপরীত। (বিশিষ্ট নওমুসলিম চিন্তাবিদ) মার্মাডিউক পিকথাল উল্লেখ করেছেন, ‘পাশ্চাত্যের জাতিগুলো নিজেদের ধর্মীয় আইনের বন্ধন ছিন্ন না করা পর্যন্ত সহিষ্ণু হয়নি। অন্যদিকে মুসলমানরা যখন নিজেদের ধর্মের বিধান থেকে বিচ্যুত হলো, তখনই সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ঘাটতি দেখা গেল।’
পশ্চিমা জগত সমাজে সম্প্রীতি আনার নামে যে পথ অবলম্বন করেছে, তা হচ্ছে, জনজীবন থেকে ধর্মের নির্বাসন দেয়া। তারা মনে করে, এই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য প্রচারণা চালানোর অধিকার তাদের রয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নেয়া উত্তম যে, গত শতাব্দীতে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে (এটা প্রশংসনীয়), এ দিক দিয়ে ইসলামের প্রদত্ত মানদ-ে উত্তীর্ণ হতে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
প্রথমত, মুসলিম পার্সোনাল ল’কে পাশ্চাত্য স্বীকৃতি দেয়নি আজো। অথচ অমুসলিম সংখ্যালঘুদের পার্সোনাল ল’কে মুসলিম বিশ্ব বরাবরই স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও আমেরিকার কোথাও লাউড স্পিকারে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয় না, মুসলিম দেশগুলোতে অমুসলিমরা অবাধে ধর্মকর্ম করার স্বাধীনতা ভোগ করছেন।
তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য মিডিয়ায় ইসলামবিরোধী অন্যায় প্রচারণা বিদ্যমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণ ও ফলাফল, দু’টিই।
চতুর্থত, ‘হেইট ক্রাইম’ বা অপর সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণাজাত অপরাধ পাশ্চাত্যে অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে একটি ছোট উদাহরণ হলো, গত সাত বছরে শান্তিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রেই শুধু মসজিদে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে প্রায় দু’ডজন। আর লোকজনের ওপর শত শত হামলার কথা না হয় না-ইবা উল্লেখ করা হলো।
পঞ্চমত, এই বাস্তব অবস্থা স্বীকার করে নেয়ার সদিচ্ছা পর্যন্ত জোরালো নয়। এখানে কেবল একটু ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে মার্কিন সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে দু’টি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। এর বিষয় ছিল, মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সমর্থন জ্ঞাপন। উচ্চকক্ষ বা সিনেটে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদে ইহুদি-খ্রিস্টানদের কয়েকটি গ্রুপের চাপে প্রস্তাবটি নস্যাৎ হয়ে যায়। ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর অন্যান্য অংশেও এ বিষয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। এই প্রেক্ষাপটে সহনশীলতা প্রদর্শনের জন্য জোর করা বা হুমকি দিয়ে অসহিষ্ণুতাই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা মানে, সংখ্যালঘুদের যথাযথ স্থান দেয়া। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অবমূল্যায়ন করাও উচিত নয়।
মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় সহনশীলতা কোনো রাজনৈতিক কৌশল নয়। বরং এটা গুরুত্ববহ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। মুসলমানদের সব ধরনের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে একটি শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। ‘সহিষ্ণুতা’র মোড়কে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শিত হলে তাকেও বাধা দেয়া চাই।’ লেখক সাংবাদিক
Check Also
সাতক্ষীরায় উগ্রবাদী সাদপন্থীদের বিরুদ্ধে তৌহিদি জনতার মানববন্ধন
নিজস্ব প্রতিনিধি ; উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সাদপন্থীদের কর্মকান্ডের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মানববন্ধন …