নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা: ২৫ ফেব্রুয়ারি সেই ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের এদিনে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। পিলখানা বিদ্রোহে নিরস্ত্র সেনা সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের ৯ম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বনানীস্থ সামরিক কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন। রবিবার সকাল ৯টায় তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে দলের সিনিয়র নেতারা আজ রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, প্রতিবারের মতো বিএনপির পক্ষ থেকে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দলের সিনিয়র নেতারা দলীয় চেয়ারপারসনের পক্ষে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
গতবছর নভেম্বরে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ১৫২ জনের মধ্য থেকে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ৮ জনকে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেয়া হয়েছে এবং একজন মারা গেছেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। বাকি ১২ জন খালাস পেয়েছেন ও ২ জন মারা গেছেন। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ২৫৬ জনের মধ্যে ২ জনের ১৩ বছর, ১৮২ জনের ১০ বছর, ৮ জনের সাত বছর, ৪ জনের তিন বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাকি ২৯ জন খালাস পেয়েছে। আর ২৮ জনের বিষয়ে আপিল না হওয়ায় তাদের আগের সাজা বহাল।
এছাড়া কারাগারে মারা গেছেন ৩ জন। খালাস পাওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৪ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার বিচার শেষ হলেও ঝুলে আছে বিস্ফোরক মামলাটি। হত্যা মামলার আপিলের রায় শেষ হওয়ার পর ১৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণের অভাবেই মূলত মামলাটি ঝুলে আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ৯ বছরেও বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় খালাসপ্রাপ্ত অন্তত তিনশ’ জনের জামিন মিলছে না।
বিস্ফোরক মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মামলার আপিল বিভাগের রায়ের পর বিস্ফোরক আইনের মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। বাকিদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা হবে বলেও জানান তিনি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, দুই মামলার আসামি ও সাক্ষীদের সংখ্যা একই। বিস্ফোরক মামলায় ১৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৫২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে মামলার বিচার শেষ করতে কত বছর সময় লাগবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের আগ্রহের অভাব রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে পরিবারগুলো হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি আরও বলেন, বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় খালাস হওয়া তিনশ’ জনের জামিন হচ্ছে না। তাদের জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন পরিবারগুলো। আদালত চাইলে তাদের জামিন দিতে পারেন।
তবে হত্যা মামলায় যারা খালাস পেয়েছেন আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এ প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল বলেন, হাইকোর্টের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহ চলাকালে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।
সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন।
এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বিচার চলার সময় বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়।
মামলার আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকেও দণ্ড দেয়া হয়। সাজা ভোগকালীন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও মারা যান।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড দেন।
এছাড়া ২৭৮ জনকে খালাস এবং ৪ জন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পান। রায়ে খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা তাদের সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্টের বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এ জন্য মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত দুই কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
রক্তাক্ত ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়। এদিকে শনিবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ জানায়, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে সোমবার বাদ আসর দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক ও শহীদ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত থাকবেন।