ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: নববর্ষের ঠিক মধ্যরাতে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের কর্তৃপক্ষ ১৯ মিলিয়ন নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু এতে হানিফ খানের নাম স্থান পায়নি।
পরদিন খুব ভোরে ট্যাক্সি চালক খানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক দৃষ্টিতে একে আত্মহত্যা বলে মনে হয়। স্ত্রী রুশকা একেবারে নিশ্চিত যে আত্মহত্যাই করেছেন তার স্বামী।
ভুটান ও বাংলাদেশের মাঝে অবস্থিত আসাম রাজ্যের সরকার দুই বছর আগে একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করে। ১৯৭১ সালের মার্চে আগে কাদের পূর্বপূরুষ এই রাজ্যের বাসিন্দা ছিলো তা খুঁজে বের করা ছিলো এর উদ্দেশ্য। যিনি এই পূর্বপুরুষের শেকড় প্রমাণে ব্যর্থ হবেন তাকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হবে।
৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে নামের যে অসমাপ্ত খসড়া তালিক প্রকাশ করা হয় তার বাইরেও ১৪ মিলিয়ন অধিবাসী রয়েছেন। কর্মকর্তারা যদিও চলছেন চূড়ান্ত তালিকায় আরো মিলিয়ন মিলিয়ন নাম যোগ হবে কিন্তু এই প্রক্রিয়া রাজ্যটিতে চরম উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। আর বলা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভারতে লাখ লাখ রাজ্যহীন অধিবাসীর সৃষ্টি হতে পারে।
আফগান পিতা ও ভারতীয় মাতার সন্তান খানের মনে এমন উদ্বেগই কাজ করেছে। যা তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়।
আসামে ‘বিদেশী’ হিসেবে চিহ্নিতদের রাখার জন্য নতুন ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা এমন সেন্টারে ইতোমধ্যে ২,০০০ মানুষকে রাখা হয়েছে। গত ছয় মাসে এদের আটক করা হয়।
রুশকা জানায় যে বাড়ির কাছে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখলেই খান ভয় পেতেন। তার ভয় ছিলো পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে।
ডিসেম্বরের দিকে সে নাওয়া-খাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো। তালিকা প্রকাশের পাঁচ ঘন্টা আগে থেকেই খান উধাও হয়ে যায়, বললেন তার স্ত্রী।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পাঁচটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগে অখণ্ড ভারত থাকাকালে এই অঞ্চলে জনগণের অবাধ যাতায়াত ছিলো। এরপরও যাতায়াত অব্যাহত থাকে সীমান্তের দুই পারেই আত্মীয়-স্বজন, পড়শি থাকার কারণে। ভারতের দাবি বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বাংলাদেশের প্রায় ১৫ মিলিয়ন নাগরিক ভারতে কাজকর্ম ও বসবাস করছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়। ২০১০ সাল থেকে এমন ১,০০০-এর বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াও দিচ্ছে ভারত।
১৯৮০’র দশকে আসমে অভিবাসী বিরোধী ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে, যা রাজ্যটিকে একরকম অচল করে তোলে। তখন এক দাঙ্গায় ১৮,০০ নিহতের ঘটনাও ঘটে। যা ছিলো উপমহাদেশ বিভক্তির পর একদিনে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা।
অভিবাসীরা স্থানীয়দের রুটি-রুজি দখল করছে বলে আসামবাসীর অভিযোগ। বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানরা সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
ধুবরি জেলার এক মুদি দোকানী বলেন, ‘২০ বছর আগে এখানে ৭৫% ছিলো হিন্দু। এখন মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।’
এই ৩০ মিলিয়ন মানুষের পরিচয় যাচাইয়ের ভার পড়েছে সিনিয়র সরকারি আমলা প্রতীক হাজেলার কাঁধে। আসামের রাজধানী গৌহাটিতে নিজ অফিস কক্ষে বসে তিনি বলেন, ‘আমরা ৬৫ মিলিয়ন দলিল সংগ্রহ করেছি।’
তবে যারা তালিকা থেকে বাদ পড়বেন তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে তা তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন।
এটা আসলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল। স্পেডইন্ডিয়া ম্যাগাজিনের তথ্য মতে, ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে ৯০,০০০ অধিবাসীকে বিদেশী হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক ডজন অধিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোন বাহিষ্কার চুক্তি নেই।
পুলিশ জানায়, বিদেশী বলে ঘোষণা করা হয়েছে এমন ৩৮,০০০ অধিবাসীর কোন হদিস নেই। অনেকের অভিযোগ তাদেরকে নির্বিচারে বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিলও করেছেন।
বিদেশী আখ্যা দিয়ে যেকোন সময় আটক ও বছরের পর বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক থাকার আশংকা পেয়ে বসেছে বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়কে। এ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি হয়েছে।
হানিফ ছাড়াও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন আরো দুটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
আদালতের রায়ের পর সরকারকে ৩১ মে’র মধ্যে নাগরিকদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তখন লাখ লাখ অধিবাসী বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু তাদেরকে সামাল দেয়ার কোন পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত ভারত সরকারের নেই।
গতমাসে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন যে যারা বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হবে তারা সাংবিধানিক অধিকার হারাবে। তাদের শুধু জাতিসংঘের দেয়া খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্রের মতো মানবাধিকারগুলো থাকবে।
বহিষ্কারের বিষয়টি পরে আসবে বলেও জানান তিনি।
এদেরকে বাংলাদেশ নেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হয়ননি ভারতের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ সরকার বলেছে আসামে কোন বাংলাদেশী নাগরিক অবৈধভাবে বাস করছে বলে তাদের জানা নেই। আর আসাম থেকে কাউকে বহিষ্কারের প্রশ্নটিও কখনো তোলেনি ভারত।
ফলে এসব রাজ্যহীন, অধিকারহীন মানুষের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়েই আশংকা প্রবল।