২৮ ফেব্রুয়ারি। কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের এই দিনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কুরআন, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামার পর সেদিন র্যাব-পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা জামায়াত-শিবিরসহ দেড়শতাধিকেরও বেশি ধর্মপ্রাণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এই দিনটিকে এখন ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় মনে করেন। আর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একদিকে হলেন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। শীর্ষ নেতা হওয়ার কারণে যেমন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার অনেক গুরুত্ব অপরদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন ওয়াজেনে কেরাম হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে তার বিশাল গ্রহণযোগ্যতা।
রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মত পার্থক্য বা রেষারেষি থাকলেও মাওলানা সাঈদীর প্রতি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীরও ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই একটি অংশ সাঈদীর ফাঁসি হোক এটা তারা চাইতো না। সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। সু-দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত দেশের আনাচে-কানাচে কুরআনের তাফসীর করে এক বিশাল গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করেছেন মাওলানা সাঈদী। তার প্রতি দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণেরও রয়েছে অকুণ্ঠ ভালবাসা আর সমর্থন। তাই কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া ফাঁসির রায়কে জামায়াত-শিবিরসহ সাধারণ মানুষ কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানের পরই এ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জামায়াত শিবির নেতাকর্মীসহ সাঈদী ভক্তরা। প্রতিবাদে সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে এসে। অচল হয়ে পড়ে পুরো দেশ। সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ বিক্ষোভে সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালায় র্যাব-পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম বুলেটের আঘাতে সেদিন সারাদেশে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ দেড়শতাধিকেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
জানা যায়, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ গণহত্যা চালিয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সে দিন রাতে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেই এটাকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করেছেন। দেশি-বিদেশি মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটাকে গণহত্যা বললেও সরকারপন্থী কিছু মিডিয়া ও সরকারি দলের লোকজন এটাকে গণহত্যা বলতে রাজি হয়নি।
অপরদিকে, নিহতের সংখ্যা নিয়েও ভুল তথ্য প্রদান করে দেশের কতিপয় মিডিয়া সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল। এমনকি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরও সংসদে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন জামায়াত শিবির, পুলিশ ও সাধারণ মানুষসহ মোট ৬৭ জন নিহত হয়েছে। তার এ তথ্য সংসদকে জানানোর পরই সাধারণ মানুষের মনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওই সময় অনেকেই বলেছিলেন গণহত্যার দায় এড়াতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণকে ভুল তথ্য প্রদান করেছেন।
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংসদে দেয়া বক্তব্যের পরের দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র সারাদেশে পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ দেড়শতাধিকেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শুধু জামায়াত শিবিরেরই ৮৫ জন নেতাকর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী থেকে প্রাপ্ত সাধারণ নাগরিক ও জামায়াত শিবিরের নিহত ১১৭ জনের জেলা ওয়ারী নামের তালিকা অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
রংপুর অঞ্চল
সেদিন রংপুর অঞ্চলে পুলিশের গুলিতে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, রংপুর ও জয়পুরহাটে জামায়াত-শিবিরের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন।
রাজশাহী অঞ্চল
প্রতিবাদ ভিক্ষোভে সেদিন ফেটে পড়ছিল রাজশাহী অঞ্চলেও। এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। সেদিন রাজশাহী অঞ্চলে পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবিরের ২৭ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিল।
ঢাকা-কুমিল্লা-সিলেট
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেদিন রাজধানী ঢাকায় ২ জন, সিলেটে ২ জন ও কুমিল্লায় জামায়াত-শিবিরের ৪ নেতাকর্মী নিহত হন।
চট্টগ্রাম অঞ্চল
মাওলানা সাঈদীর প্রতিবাদে চট্টগ্রামেও রাস্তায় নেমে এসেছিল জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। এই অঞ্চলেও আওয়ামী পুলিশ তাদের বুলেটের আঘাতে কেড়ে নিয়েছে ১৪ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর জীবন।
খুলনা অঞ্চল
মাওলানা সাঈদীর অন্যায় রায়ের বিরুদ্ধে অচল হয়ে গিয়েছিল খুলনা অঞ্চল। এই অঞ্চলে পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু প্রতিবাদী মানুষের ওপর গুলি চালাতে ভুল করেনি পুলিশ। পুলিশের নির্মম বুলেটের আঘাতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় জামায়াত-শিবিরের ১১ নেতাকর্মী প্রাণ হারান।
গণহত্যার শিকার ৩৩ সাধারণ নাগরিক
শুধু জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাই সরকারের গণহত্যার শিকার হন নি। গণহত্যার শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষও। সারাদেশে পুলিশ ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।
নিহত ৩৩ জন সাধারণ নাগরিকের মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরার ১০ জন। এরা হলেন হরিশপুরের আবদুল বারীর ছেলে ইকবাল হাসান তুহিন (২০), পায়রাডাঙ্গা গ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে শাহিন আলম (২২), ওফাপুরের আবদুল মজিদ মোড়লের ছেলে শামসুর রহমান (৩৮), রইচপুরের মফিউদ্দিনের ছেলে মাহবুব (৩০), একই এলাকার আবদুস সবুরের ছেলে স্কুলছাত্র সোহাগ (১৫), কলারোয়ার কামারালি গ্রামের মৃত আবদুর রহিমের ছেলে ও বাকি চার নিহত নিখোঁজের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এরপর বগুড়ায় ৭ জনের মধ্যে দহপাড়ার মনু মিয়ার ছেলে ইটভাটার শ্রমিক সাদেক আলী (৪০), শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুরের মেহরাজের স্ত্রী আর্জিনা বেগম (৪৫), ডোমনপুকুর গ্রামের তোতা মিয়ার স্ত্রী মঞ্জিলা বেগম (৩৮), ডোমনপুকুর নতুনপাড়ার মৃত মুনছের আলীর স্ত্রী আছিয়া বেগম (৫০), আবদুর রহমান (৪৫), মোকামতলা ইউনিয়নের মুরাদপুর গ্রামের আলহাজ দবির উদ্দিনের ছেলে দুলু মিয়া (৪৫) ও শিবগঞ্জ উপজেলার পার আঁচলাই গ্রামের লুত্ফর রহমানের ছেলে জিয়াউল ইসলাম (৩০)।
ঠাকুরগাঁওয়ে ৩ জনের মধ্যে সাইকেল মেকার নিরঞ্জন কুমার, শিশু সাইদুল (৭) ও অজ্ঞাত একজন।
নোয়াখালীর ২ জনের মধ্যে মজিবুল হকের ছেলে পিকআপ ভ্যানচালক খোকন (২৪) ও আবুল কালামের ছেলে শ্রমিক নুরুদ্দিন (১৯)।
রাজধানীর মিরপুরে ৬৫ বছর বয়সের অজ্ঞাত মুরব্বি, কেরানীগঞ্জের জীবন নামে ১৫ বছরের বালক।
কক্সবাজারে ৩ জন। পেকুয়া ইউনিয়নের পূর্বমেহের নামার জালাল আহমদের ছেলে সাজ্জাদ (১৫), ইসলামাবাদ ইউনিয়নের সাতজোলাকাটা গ্রামের হাজী মো. ইলিয়াসের ছেলে সৌদি প্রবাসী আবদুর রশিদ ও কাউনিয়ার এক দোকান ব্যবসায়ী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ জন। প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম (৫৫) ও নামো ধোবড়া এলাকার মকবুল হোসেনের ছেলে আবদুর রহিম (৪৩)।
সাতকানিয়ার ওসমান গণি (৩৩), চট্টগ্রামের অজ্ঞাত একজন ও বাঁশখালীর হিন্দু ধর্মাবলম্বী দয়াল হরি।