স্টাফ রিপোর্টার : আজ শুক্রবার ঊনিশশ’ একাত্তর সালের টালমাটাল ঘটনার স্মৃতিবাহী মাস মার্চের দ্বিতীয় দিন। ঊনচল্লিশ বছর আগেকার এ দিন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতা-উন্মুখ বাঙালি জাতির গোপন আকাক্সক্ষা। দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় এক ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে গাঢ় সবুজের মাঝে লাল বৃত্তে বাংলাদেশের সোনালী মানচিত্র খচিত স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু)-এর ভিপি আ স ম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে যখন পতাকা উত্তোলন করেন, তখন বটতলা ছিল জনসমুদ্র। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। সংগ্রাম পরিষদে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ। এই পতাকা উত্তোলনের খবর ছড়িয়ে পড়লে দুপুরে সুপ্রিমকোর্ট, সচিবালয়সহ সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
উল্লেখ্য, পতাকা ডিজাইনের পরিকল্পনায় ছিলেন মনিরুল ইসলাম মার্শাল গনি, কাজী আরেফ আহমেদ ও শাজাহান সিরাজ। পরদিন ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সাথে সাথে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে বছর ২৫শে মার্চ কালো রাতের নৃশংস বর্বর গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনার আগে থেকেই মার্চ জুড়ে সারাদেশ ছিল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে ‘ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি’। সে সময়ের দৃশ্য সম্পর্কে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অলি আহাদ বর্ণনা করেন, জাতীয় পরিষদ মুলতবী ঘোষণায় হতচকিত ঢাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন এবং ঢাকা জেলা বার এসোসিয়েশনের প্রতিবাদ মিছিল রাস্তায় নামে। ছাত্রসমাজ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে নেমে আসে রাজপথে। প্রত্যন্ত শিল্পাঞ্চল হতে শ্রমিকরা দলে দলে মিছিল সহকারে রাজধানী ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেয়। সকল সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতার স্রোত আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারী পার্টির সভাস্থল ঢাকার মতিঝিলে হোটেল পূর্বানীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলকারীরা অযুতকণ্ঠে আওয়াজ তুলে “পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করো।’’ এমনিতরো ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পরিবেশে হোটেল পূর্বানী থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ গণতান্ত্রিক মূলনীতি লংঘন করেছেন। এটি জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এর প্রতিবাদে তিনি ২রা মার্চ ঢাকা, ৩রা মার্চ সারাদেশে সাধারণ হরতাল এবং ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গণসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এডভোকেট বদরুদ্দিন আহমদ তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য কাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘ক্ষোভে দুঃখে বাংলার মানুষ ফেটে পড়লো। তারা ভাবলো যেহেতু বাংলার নেতার হাতে পাকিস্তান শাসন করার ক্ষমতা এসে যাচ্ছে সেই কারণে কূটকৌশল গ্রহণ করে ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্র গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। ২রা মার্চ মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতা পল্টনের জনসভায় বললেন, আওয়ামী লীগ গণপরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এখন পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা আইনত শেখ মুজিবের। মওলানা সাহেব, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য শেখ মুজিবকে বার বার অনুরোধ জানান।’’ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবী ঘোষণায় নূরুল আমীন, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক গোলাম আযম প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দ তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক গোলাম আযম, যিনি পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন, বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, দেশ যখন একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ঠিক তখনই গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ক’দিনের ঘটনা প্রবাহ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় বিশেষ মহল দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করছে। ১৯৭১ সালের আজকের দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সেদিন সারাদেশ ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। গণরোষের শিকার গবর্নর হাউজ পাহারার জন্য হেলিকপ্টারে সৈন্য এনে সেখানে মোতায়েন করা হয়। সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়। স্বাধীনতাকামীদের উদ্বেল-উত্থানকে প্রতিহত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে সামরিক সরকার। সামরিক জান্তার নির্দেশে সেনাবাহিনী মিছিলে নির্বিচারে গুলী চালালে স্বাধীনতাকামী ৬ ব্যক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই মৃত্যু গণআন্দোলনের আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দেয় দেশের সর্বত্র।