ভারতের আগ্রাসনে ফেনী নদী হুমকিতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুহুরী সেচ প্রকল্প : মাটিরাঙ্গার ১৭শ’ একর জমির দখল ছাড়ছে না

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:    নিজাম উদ্দিন ছাগলনাইয়া থেকে : আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে গায়ের জোরে অবৈধ ভাবে ফেনি নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে ভারত। দেশটির দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার ১৭টি সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বিদ্যুৎ চালিত উচ্চ ক্ষমতার প্রায় ৩৪টি লো-লিফট পাম্পের মাধ্যমে ফেনি নদীর পানি তুলে নেয়া হচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরি প্রজেক্ট’। খরা মৌসুম আসার আগেই ফেনি নদীর আশপাশের ২৫টি খাল-ছরা এখনই শুকিয়ে গেছে। পানি কমে যাওয়ায় সেচ তো দূরের কথা আশপাশে পরিবেশ বিপর্যয় ও জীববৈচিত্র পড়ে গেছে হুমকির মুখে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে ফেনি নদীর প্রবাহ থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে পা¤প হাউস স্থাপন করে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলার ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলারও অন্তত ১০টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠ পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ফেনী নদীর দৈর্ঘ ১১৬ কিলোমিটার। নদীর প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত। খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম পাশাপাশি এলাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুত্রে জানা যায় শুল্ক মৌসুমে ফেনী নদীতে পানি থাকে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক। অথচ ভারত নিতে চায় এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি। শুধু তাই নয় ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে এর আশপাশের প্রায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে প্রতিবেশি দেশটি। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির গুইমারা সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম জাহিদুর রশীদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ভারত ফেনী নদী থেকে ৩৪টি উচ্চ ক্ষমতাস¤পন্ন পা¤প বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে। দুই দেশের সচিব এবং ডিজি পর্যায়ে বৈঠকে পা¤পগুলো তুলে নিতে বিএসএফকে অনুরোধ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। মাটিরাঙা উপজেলা চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম জানান ভারতের দখলে থাকা বিভিন্ন সীমান্তের বাংলাদেশের ভূমি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসালংয়ের এক হাজার ৭০০ একর ভূমিও উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ শামছুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় ভারত গোপনে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নেওয়ার চক্রান্ত করছে।
চট্টগ্রামের মীরসরাই আর ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ বাংলাদেশেই উৎপত্তি হওয়া ফেনী নদীতে ১৫৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাঁধ দিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ কোন চুক্তি ছাড়া, কোন প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই এ ফেনী নদী থেকে ভারত চুরি করছে পানি। অবিরাম পানি চুরির ফলে এখন শুষ্ক মৌসুমে অবশিষ্ট পানি শুকিয়ে নদীর তলাই দেখা যাচ্ছে। মীরসরাই, ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজীর অর্ধশত খাল ছরাও গেছে শুকিয়ে।
১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম নেই। পাউবো ও বিজিবির দফায় আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের পরও হচ্ছে না কোন ফল। ফেনী নদী থেকে বয়ে আসা মীরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট, ২নং হিঙ্গুলী, ৩নং জোরারগঞ্জ, ৪নং ধূম ও ৫নং ওচমানপুর ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি খাল ছরা এখন শুকিয়ে সেচ তো দূরের কথা পরিবেশ রক্ষা ও হুমকিতে রয়েছে। একইভাবে ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলারও অন্তত ১০টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠ পানিশূন্য হয়ে আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ গত ৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তির ২০ বছরেও প্রয়োজনীয় পানি দেয়নি ভারত। দু’দেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ভাগবাটোয়ারা এখনো মীমাংসা হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের বাহানায় দীর্ঘদিন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তিস্তা চুক্তি। আর এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফেনী নদীর পানি গোপনে তুলে নিচ্ছে, আবার এ নিয়ে মাথা ঘামানোর পর শুধুমাত্র এই নদীর পানি নিতে চুক্তি করতে চায়। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার ১৭টি সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বিদ্যুৎ চালিত উচ্চ ক্ষমতার প্রায় ৩৪টি লো-লিফট পা¤প স্থাপন করে মাটির নিচে নদী তীরের কাছে শতাধিক কিউসেক পানি গোপনে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে আপত্তি জানানো হলেও কর্ণপাত করছে না ভারত। শুল্ক মৌসুমে ফেনী নদীতে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক পানি থাকে। তা থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে নোম্যান্সল্যান্ড এই নদীর তীরে গোপনে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে তারা ৩৪টি পা¤প বসিয়েছে এবং এসব পা¤প মেশিনে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি সিআই পাইপ লাগানো হয়েছে। এসব মেশিন দিয়ে গোপনে নদী থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল যা আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নীতির চরম লঙ্ঘন। এর আগে ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশের তরফ থেকে পানি উত্তোলনের বিষয়ে বিরোধিতা করা হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে গোপনে আবার পানি উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। অপরদিকে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে এর আশপাশের প্রায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে ভারত। এদিকে ভারত ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘মুহুরি প্রজেক্ট’। বিশেষ করে নদীতে পানি কমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায় চাষাবাদ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নিতে চাইছে ভারত। বিষয়টি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার আগেই নিয়মিত পানি তুলে নিচ্ছে তারা। ফেনী নদী ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে এ নদী রয়েছে প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে। খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম পাশাপাশি এলাকা। ওই এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর প্রবাহ থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে পা¤প হাউস স্থাপন করে নদী থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পা¤প হাউস থেকে নদীর পানির ধারা পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে ৭-৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ লাগিয়ে পানি তুলে সাবরুম মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করছে ভারত। দক্ষিণ ত্রিপুরার অমরপুরের শিলাছড়ি থেকে সাবরুমের আমলীঘাট পর্যন্ত পা¤প হাউসগুলো স্থাপিত হয়েছে। সেগুলোকে বেশিরভাগ বাংলাদেশের রামগড়ের সীমান্তবর্তী লাচারিপাড়া থেকে মিরসরাইয়ের অলিনগরের বিপরীত দিকে অবস্থিত। বাংলাদেশের বাঁধা উপেক্ষা করে বছরের পর বছর পানি নিয়ে যাচ্ছে ভারত। এতে বাংলাদেশের ফেনী, রামগড় ও মিরসরাইয়ের সীমান্তবর্তী এলাকার হাজার হাজার একর জমিতে পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত শত ফলের বাগান। এ কারণে পথে বসার উপক্রম হয়েছে এলাকার কৃষকদের। একইভাবে পানির অভাবে হুমকির মুখে পড়ছে ফেনীর ‘মুহুরি প্রজেক্ট’ও। শুষ্ক মৌসুমে পানি নিয়ে যাওয়ায় ধু-ধু চরে পরিণত হচ্ছে ফেনী নদী। পাউবো চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের জন্য ভারতকে কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। বিষয়টি নি®পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নদী থেকে পানি না নিতে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।’ ২০১৭ সালের শুরুতে চট্টগ্রামে ভারত এবং বাংলাদেশের জেলা প্রশাসক পর্যায়ে সম্মেলনে ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি উত্তোলন না করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। ভারত যদি ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন করে থাকে, এটি কন্ট্রোল করার দায়িত্ব বিজিবির। খাগড়াছড়ির গুইমারা সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম জাহিদুর রশীদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ভারত ফেনী নদী থেকে ৩৪টি উচ্চ ক্ষমতাস¤পন্ন পা¤প বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে। দুই দেশের সচিব এবং ডিজি পর্যায়ে বৈঠকে আমরা পা¤পগুলো তুলে নিতে বিএসএফকে অনুরোধ করেছি। এ বিষয়ে লিখিত চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নদী বিশেষজ্ঞরা জানান, কোনো রকম চুক্তি ছাড়া ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক নদী আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন। উজানে থাকা দেশ এভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ১৯৩৪ সাল থেকে ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধ চলে আসলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থলই নির্ধারণ করতে পারেনি। ফেনী নদীর উৎপত্তি ভারতের মধ্যে বলে দাবি করে আসলেও মূলত এর উৎপত্তি বাংলাদেশেই। ভারতের দাবি ফেনী নদীর উৎপত্তি হচ্ছে ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়শ্রেণী। কিন্তু জানা গেছে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি উপজেলা মধ্যবর্তী ভগবানটিলা নামের একটি পাহাড় থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এই পাহাড়ের ছড়া থেকে উৎপত্তির পর নদীটি বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরার ইজেরা গ্রামে প্রবেশ করে এবং ইজেরা গ্রাম থেকেই নদীটি ফেনী নাম ধারণ করে। এরপর দুই দেশের সীমানাকে বিভক্ত করে অনেকটা অগ্রসর হওয়ার পর নদীটি চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইর আমলীঘাট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেনীর ছাগলনাইয়া, মিরসরাই সোনাগাজী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীটির উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। রামগড় পর্যন্ত প্রায় ৮০.৫ কিলোমিটার সারা বছর ছোট নৌকা চলার মতো নাব্যতা থাকে। মুহুরি সেচ প্রকল্পের প্রায় ৭০ ভাগ পানির উৎস ফেনী নদী। ফলে পানির অভাবে ফেনী নদী নাব্যতা হারালে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরি সেচ প্রকল্পের (এমআইপি) চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ইরি সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মুহুরি সেচ প্রকল্প ফেনী, মুহুরি ও কালিদাস পাহালিয়া- এ তিনটি নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এ প্রকল্পের আওতায় যেখানে তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচকাজ করার কথা, সেখানে পানির অভাবে অনেক জমিতে সেচকাজ সম্ভব হয়ে ওঠছে না। ফেনী থেকে ২৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-ফেনী জেলার সীমানায় মুহুরি সেচ প্রকল্পটির অবস্থান। অনেক চিংড়ি ঘের রয়েছে এখানে। নদীর ওপর ১৯৬৫-৬৬ সালে ৫৯৩.৫ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে প্রায় ৩.৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সমুদ্রের লোনা পানির প্রবেশ রোধ করা এবং মুহুরি সেচ প্রকল্পের কাজে পানির জোগানের জন্য এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ভারত ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখলে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু প্রকল্পটির হুমকিই নয়, নদীর পানি প্রবাহ কমে গেলে সুমদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। এতে জীববৈচিত্র মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। ভারত তাদের ত্রিপুরার বৃহৎ সেচ প্রকল্প চালু করলে নদী অববাহিকা এলাকায় মরুভ‚মি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। এছাড়া ফেনী, মুহুরি ও কালিদাস নদীকে ঘিরে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। পানি সঙ্কটে এইসব খামার ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০ থেকে ২২ হাজার জেলে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, ফেনী নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে মুহুরী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য ফেনী নদীতে পানি রিজার্ভ করে রাখে বাংলাদেশ। ভারত সেখান থেকেই অবৈধভাবে পানি উত্তোলন করছে। ফেনী জেলা পানি ব্যবস্থাপনা এসোসিয়েশনের সভাপতি ও ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আমি এখনো দেখিনি তবে শুনেছি ভারত ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে। যদি পানি তুলে নিয়ে থাকে তাহলে সেটা অন্যায়। শুল্ক মওসুমে ফেনী নদীতে এমনিতেই পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়না। অথচ মুহুরী প্রকল্পটি পুরোটাই ফেনী নদীর পানি নির্ভর একটি সেচ প্রকল্প। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ফরহাদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ভারত জেআরসির অনুমোদন ছাড়া অন্যায়ভাবে ফেনী নদী থেকে পাম্প বসিয়ে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এটি মারাত্মক অন্যায়। সরকারের তরফ থেকে এখনি প্রদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এদিকে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে এর আশপাশের প্রায় এক হাজার ৭০০ একর জমি দখল করে রেখেছে ভারত। ১৯৩৪ সালের আন্তর্জাতিক সীমারেখার মানচিত্র ১৯৯০ সালে পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব জমি স্থায়ী মালিকানা হিসেবে দেখিয়ে দখল করা হয়েছে। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় আসালং মৌজার অপদখলীয় এই সম্পত্তি রক্ষায় সশস্ত্র পাহারা বসিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সেখানে রাতে জ্বলছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সার্চলাইট। সরেজমিনে ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিগত সরকারগুলো মাটিরাঙায় ভারতের অপদখলীয় বাংলাদেশের এই বিপুল পরিমাণ ভূমি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিলেও গত ৩১ বছরে এর কোনো সফলতা মেলেনি। ফলে জমি রক্ষার সংগ্রামে জীবন দেওয়া চার শহীদের রক্ত বৃথা যেতে বসেছে। আসালং মৌজার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ‘বিএসএফের সহযোগিতায় ভারতীয়রা রাতের বেলায় ফেনী নদীতে বাঁধ তৈরি এবং নালা খননের কাজ করত। বাংলাদেশের বিডিআর ওই সব বাঁধ ও নালা একাধিকবার ভরাটও করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতীয়রা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী খননকাজ সম্পন্ন করে দখলে নিয়ে ফেলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ ভূমি। ভারতের দখল করা এসব জমিতে আগে মাটিরাঙার বগাপাড়া ও সর্বেশ্বরপাড়ার বাসিন্দারা ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করত। কিন্তু এখন উর্বর এসব জমি ভারতীয় নাগরিকরা ভোগ করছে। সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, মাটিরাঙা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তাইন্দং ইউনিয়নের ১৮৩ নম্বর আসালং ও তাইন্দং মৌজার প্রায় এক হাজার ৭০০ একর ভূমি ১৯৮৬ সালের দিকে ভারত দ্বিতীয়বার দখল করে। ওই সময় শান্তিবাহিনীর অব্যাহত নাশকতার কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয় সরকার। জনশূন্যতার এই সুযোগে ভারতীয়রা বিএসএফের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিশাল ভূমিটি দখল করে নেয়। দখল করা ভূমির বেশির ভাগই বনাঞ্চল ঘেরা টিলাভূমি ছিল। এর মধ্যে কৃষিজমিও ছিল দুই শতাধিক একর। এলাকাবাসী জানায়, বিএসএফ ওই সময় সে দেশের নাগরিকদের দিয়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত মূল ফেনী নদীর বিপি ২২৬১ নম্বর সীমান্ত পিলারসংলগ্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে এবং নতু নালা খনন করে নদীর জলধারা সীমান্ত থেকে বেশ ভেতরে (বাংলাদেশ ভূখন্ডে কয়েক হাজার গজ) প্রবহমান ছোট ফেনী ছড়া খালের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়। এতে মূল নদীর নিচের অংশ শুকিয়ে গেলে সেখানে মাটি ও আবর্জনা দিয়ে ভরাট করা হয় নদীটির বেশির ভাগ এলাকা। ভরাটের সূত্র ধরে তারা মূল ফেনী নদী ও ছোট ফেনী ছড়া খালের মধ্যবর্তী বাংলাদেশের বিশাল জায়গা দখল করে এবং ছোট ফেনী ছড়া খালকে সীমান্ত নদী হিসেবে দাবি করে। সীমান্তবর্তী বাঙালি পাহাড়ি গ্রামবাসীরা জানায়, ভারত ১৯৬১ সালের দিকে প্রথম আসালং ও তাইন্দং মৌজার বিশাল জায়গা দখল করে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ১১ উইংয়ের ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বিএসএফের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভূমিটি পুনরুদ্ধার করে। আসালং যুদ্ধ নামে পরিচিত ১৭ দিনের যুদ্ধে ইপিআরের এক হাবিলদার ও তিন সিপাহি শহীদ হন। এখনো এর নীরব সাক্ষী হিসেবে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির তাইন্দং বিওপি সংলগ্ন স্থানে এই চার শহীদের কবর ও স্মৃতিস্ত¯¢। জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত আবার ওই জায়গা দখল করে। ১৯৯০ সালের জরিপে ভারতীয়দের খনন করা ছোট ফেনী ছড়া খালকে মূল ফেনী নদী হিসেবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দুই দেশের ওই জরিপদল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর (বর্তমান বিজিবি), জেলা প্রশাসক বা সীমান্তের বাসিন্দাদের মতামত নেয়নি। এভাবেই কৌশলে ১৯৩৪ সালের মানচিত্রের আন্তর্জাতিক সীমারেখা পরিবর্তন করে ভারতকে বাংলাদেশের ভূমি দখলে রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, অপদখলীয় এসব ভূমির ওপর বিএসএফের দুটি ক্যাম্প, পাকা রাস্তা, বৈদ্যুতিক পিলারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতীয় নাগরিকরা চাষাবাদ করছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা সীমান্তের আসালং মৌজার বিপুল পরিমাণ ভূমি ২৬ বছরেও উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। বিজিবির একটি সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালের মে মাসে ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমায় তৎকালীন বিডিআরের খাগড়াছড়ি সেক্টর কমান্ডার এবং বিএসএফের ত্রিপুরার ডিআইজি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে আসালংয়ের অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারে দুই দেশের সরকারের মধ্যে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ড ভূমিটি উরংঢ়ঁঃবফ ষধহফ বা অমীমাংসিত ভূমি হিসেবে স্থিতাবস্থা বা ঝঃধঃঁং য়ঁড় বজায় রাখার যৌথ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ভারত তা অমান্য করে ওই সময়ে অপদখলীয় ভূমির ওপর ফেনী ছড়া বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীতে বিপি ২২৫২ নম্বর সীমান্ত পিলার সংলগ্নে জলাইয়া বিএসএফ ক্যাম্প এবং বিজিবির ভগবানটিলা বিওপির বিপরীতে বিপি ২২৬১ নম্বর পিলার এলাকায় ভগবান টিলা বিএসএফ ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ছাড়া দখল করা ভূমির ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা ও বৈদ্যুতিক লাইনের পিলারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে। মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শামছুল হক দৈনিক  বলেন, ‘সীমান্তের ওই এলাকা অরক্ষিত থাকার দরুন ভারত গোপনে ফেনী নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে সরকারের উচিত, ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমাদের এই ভূসম্পদ পুনরুদ্ধার করা। জমাবন্দির বই না থাকায় জমির খাজনা আদায় করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া জমি বেচাকেনাও করতে পারছেন না কেউ। মাটিরাঙা উপজেলা চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘গত বিএনপি সরকারের আমলে ভারতের দখলে থাকা বিভিন্ন সীমান্তের বাংলাদেশের ভূমি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসালংয়ের এক হাজার ৭০০ একর ভূমিও উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে ২০০৪ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম ভারতের এ অপদখলীয় বিশাল ভূমি সরেজমিনে দেখতে আসালং পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে মন্ত্রীকে তৎকালীন বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভারত কিভাবে বাংলাদেশের এই বিশাল ভূমি দখল করেছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। ওই সময় মাটিরাঙাবাসীর পক্ষ থেকেও জমিটি উদ্ধারের জন্য মন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী জমিগুলো পুনরুদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু —।ইনকিলাব

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।