ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আর নেই:মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সংগ্রামী জীবন

ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট: মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আর নেই। ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১টায় রাজধানীর বেসরকারি ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
খ্যাতিমান এই মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট-সিসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
——————–0———————-
শৈশবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাড়ির সামনে দিয়ে বায়স্কোপওয়ালা যেতেন। তারা নানা রকম ছবি দেখাতেন। রানীর ছবি, তাজমহল ও নায়িকাদের ছবি। ছোট্টবেলায় বায়স্কোপের ছবির ওপর আটকে থাকা সেই চোখ জোড়া দিয়েই তিনি পরবর্তীতে প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পেয়েছেন এক শৈল্পীক রূপ।

প্রকৃতির মগ্নতার মাঝে তার চিন্তার মূর্তরূপ ফুটে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভাস্কর।

নিছকই তুচ্ছ গাছের ডাল, শেকড়-বাকড়, কাঠের পরিত্যক্ত টুকরা, পোড়া কাঠ, শেওলা ধরা ভাঙা বাশের টুকরা, পচে যাওয়া কাঠ, অযত্নে বেড়ে ওঠা কোনো উদ্ভিদের মাঝে খুঁজে বের করেন বৈচিত্র্যময় শৈল্পিক রূপ

তার শিল্পকর্ম বেশ জনপ্রিয়। মূলত সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কীভাবে ঘর ও নিজেকে সাজানো যায়, সেই কৌশল অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তার শিল্প চর্চার শুরু।

তিনি কাজ করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ে। তিনি মানুষকে দেখিয়েছেন, কীভাবে অল্প খরচে সহজে ঘর সাজানো সম্ভব।

প্রিয়ভাষিণীর ব্যক্তি ও শিল্প জীবনে নানা বাড়ির বিশাল প্রভাব রয়েছে। কেননা তার শৈশব-কৈশরের মজার দিনগুলো ওই বাড়িতেই কেটেছে।

১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন প্রিয়ভাষিণী। ডাক বাংলোর মোড়ে সেই বাড়ির নাম ছিল ফেয়ারি কুইন বা পরীর রানী। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হওয়ার তার প্রথম সুযোগটা ঘটে সেখানেই।

তার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক ও মা রওশন হাসিনা। ১১ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

প্রিয়ভাষিণীর নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম কংগ্রেস করতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শাসনকালে তিনি স্পিকার হয়েছিলেন। প্রিয়ভাষিণীও নানার পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। তখন তার বয়স পাঁচ পেরিয়েছিল। প্রথমবারের মতো স্কুলে যাওয়া শুরু করেন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে।

তার বাবা তার নানা বাড়িতে থাকা নিয়ে ঝামেলা করতেন। তাই ৯ বছর বয়সে তাকে বাবার কাছে চলে যেতে হয়। তার বাবা তখন খুলনার দৌলতপুর কলেজে কমার্সের শিক্ষক ছিলেন।

তার দাদার বাড়ি ফরিদপুর শহরের চর কমলাপুর রোডে। বর্তমানে যার নাম খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেন রোড। দাদা সৈয়দ জহুরুল হক ছিলেন বড় লাটের কেয়ারটেকার। তিনি ইউরোপীয় চিন্তাধারা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন।

১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিয়ে করেন। ১৯৭১ সালে তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে তিনি সন্তানদের নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। কিন্তু তার ভাঙা সংসারের জীবনে তখন চরম বিপর্যয় নেমে আসে। তিনি পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন।

এরপরে তাকে এক দুঃসহ জীবন পার করতে হয়েছে। তার ভাষায়, যে খালা-মামারা সারাজীবন এত সংস্কৃতি চর্চা করেছেন, পাক হানাদারদের নির্যাতনের পর তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। আমার দ্বিতীয় স্বামী সব কিছু জেনে বুঝে বিয়ে করা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে আমাকে নিরুৎসাহিত করতেন। শুধু এই একটা কারণেই।

১৯৭২ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ের পিড়িতে বসেন। তার দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ ছিলেন সরকারের প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তা। প্রিয়ভাষিণীর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে।

তিনি খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, খুলনা গার্লস স্কুল থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন।

১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এফএও ও কানাডিয়ান দূতাবাসেও চাকরি করেন।

প্রিয়ভাষিণীর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমিতে। এস এম সুলতান সেই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। তার প্রদর্শনী দেখে শিল্পী হাসেম খান বলেন, তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের ভাস্কর্য তৈরি করতে পেরেছেন। আমাদের দেশের ভাস্কর্য নির্মাণে তিনি নতুন ধারা তৈরি করেছেন।

শিল্পকলায় অবদান রাখায় তিনি ২০১০ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়।

২০১৪ সালের একুশের বইমেলায় তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ নিন্দিত নন্দন প্রকাশিত হয়।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।