‘এরদোগান: দ্যা চেঞ্জ মেকার’ বইয়ের পেছনের কিছু গল্প;বাংলায় নিজের জীবনী দেখে অভিভূত এরদোগান

আঙ্কারা: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান নিজের জীবনী নিয়ে বাংলা ভাষায় বই রচিত হয়েছে শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরেন বইটির লেখক হাফিজুর রহমানকে। শত সহস্র মাইল দূরের একটি ছোট্ট দেশের কোটি কোটি মানুষের ভালবাসার কথা শুনে এই পরাক্রমশালী বিশ্ব নেতা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।এসময় তিনি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ এর প্রতি শ্রদ্ধা আর নিজের অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মানুষের সকল বিপদে পাশে থাকবেন বলেও তিনি তার প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

এর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের জীবনী নিয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত বই, ‘এরদোগান: দ্যা চেঞ্জ মেকার’ এরদোগানের হাতে তুলে দেন বইটির লেখক হাফিজুর রহমান। একে পার্টির পার্লামেন্টারী গ্রুপের মিটিংয়ের বিশেষ সেশনে বই তুলে দেওয়ার সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিম, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, একে পার্টির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং সকল এমপিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

লেখক প্রেসিডেন্টকে বইটিতে স্থান পাওয়া বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন এবং বইটি বাংলাদেশী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি এরদোগানের প্রতি বাংলাদেশীদের আবেগ ও ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন।

প্রেসিডেন্ট এরদোগান বইটি লিখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানান এবং তার প্রতি এ ধরনের ভালোবাসায় জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বই তুলে দেওয়ার সময় লেখকের সাথে তুরস্কের অন্যতম সিভিল সোসাইটি সংগঠন ‘ইয়েনী দুনিয়া ভাকফি’ এর চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মাহমুদ গুকসু, সংসদ সদস্যবৃন্দ, ইয়েনী দুনিয়া ভাকফি আঙ্কারা শাখার সভাপতি ও কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, হাফিজুর রহমান তুরস্কের গাজী ইউনির্ভাসিটিতে রাজনীতি ও লোক প্রশাসন বিভাগে পিএইচডি করছেন এবং ইয়েনী দুনিয়া ভাকফি আনকারা শাখার ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

‘এরদোগান: দ্যা চেঞ্জ মেকার’ বইয়ের পেছনের কিছু গল্প

হাফিজুর রহমান

বইটি লেখার কাজ শুরু করা ২০১৬ সালের জুন মাসে। বই লেখার জন্য প্রথম যখন তথ্য কালেকশান শুরু করলাম তখন অনেকটা সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার মত অবস্থা, কোন কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুরুতেই বিষয়টি শেয়ার করেছিলাম আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ড. আকিফ হুজার সাথে। উনি আমাকে এতই উৎসাহ দিলেন যে, আমি সত্যিই বড় একটি আশ্রয় খুঁজে পেলাম। উনার সাথে সেদিন আমার প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা কথা হয়েছিল। উনি অনেকগুলো বই, আর্টিক্যাল এবং থিসিস পেপার দিয়ে বলেছিলেন এগুলো পড়ো এরপর কাজগুলো সহজ হবে। এর পাশাপাশি উনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জনাব এভরেন বাশার সাহেবের কাছে, উনিও আমাকে নিরাশ করেননি। বেশ কিছু বই ও প্রয়োজনে প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের লাইব্রেরী ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।

শুরু করলাম সংগৃহীত রেফারেন্সগুলো পড়া। কিন্তু লিখতে শুরু করতে পারছিলাম না। লিখতে গেলে মনে হতো আরো পড়ে অভিজ্ঞ হয়ে লেখা শুরু করা দরকার। এমন সময় আমার সুপারভইজার ড. এমরাহ বেরিস হুজামকে বিষয়টা খুলে বললাম। উনার দুটি কথা কখনো ভুলব না, যা আমার সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। উনি বলেছিলেন, ‘হাফিজ, তুমি অভিজ্ঞ হওয়ার পর লিখবে এমন চিন্তা করলে কখনো লেখা হবেনা। যা পড়ছো তা দিয়েই লিখা শুরু করো। আর যা লিখবে তাই ফাইনাল তাও কখনো মনে করবে না। লিখবে এরপর আবার নতুন নতুন রেফারেন্স পড়বে ওগুলো যোগ করবে, আর আগের লেখাগুলো থেকে অপ্রোয়োজনীয়গুলো বাদ দিবে’।

শুরু হল লেখা। চারমাস টানা চলল। এরমাঝে আমার সহধর্মিনী তুরস্কে আসল, আমাদের আনুষ্ঠানিক সংসার জীবন শুরু হলো। আর ওদিকে আমার পিএইচডি কোর্স ওয়ার্ক আর কোয়ালিফিকেশন এক্সামের সময় চলে এলো। তাই মাঝখানে কয়েকমাস কাজ অনেকটা থমকে ছিল।

প্রকাশক নূর ভাই প্রায়ই ফোন দিতেন। নূর ভাই ফোন দিলেই বুঝতাম বইয়ের কাজ কতটুকু তা জানতে চাইবেন। যদিও উনি খুব ভাল টেকনিক অবলম্বন করতেন। আমি বলার আগে জিজ্ঞাসাই করতেন না যে কতটুকু শেষ করেছি! বলতেন, ভাবি কেমন আছে, পড়াশোনা কেমন চলছে? ওগুলো জিজ্ঞাসা করলে আমি হাসতাম আর বলতাম জ্বি ভাই, বুঝছি……. বইয়ের কাজ এত শতাংশ শেষ হয়েছে।

এরমাঝে তুরস্ক ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন গুণীজনের সাথে বইয়ের ব্যাপারটি শেয়ার করলাম। সকলেই ব্যাপক উৎসাহ দিলেন। বিশেষ করে তুরস্কের মুরুব্বীরা, দেখা হলেই বলতেন, কি খবর? কত দূর?

কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসে মনে হল বই শেষ করার জন্য মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসে পৌছেছি। এখন কিছু এক্সক্লুসিভ বিষয় দরকার। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের সাক্ষাতকারগুলো আসা দরকার। তাদের কাছ থেকে মনের উদ্রেক হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দরকার আর একদম ভিতরের কিছু কথা বের করে আনা দরকার।

এরপর নয়জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছি যাদের সাতজনই প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে তুরস্কের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, আর দুজন তুলনামূলক যুবক বয়সী। প্রতিটা সাক্ষাতকারই আমার কাছে একেকটা জীবন্ত বই মনে হয়েছে। একেকজনের সাথে চার-পাঁচঘন্টা পর্যন্তও কথা বলেছি, কারো সাথে একদিনে শেষ হয়নি দুদিন/তিনদিন কথা বলেছি। এগুলোর বিস্তারিত ঘটনা লিখলে অনেক কিছু লিখতে হবে, কিন্তু এখানে বড় করে লিখাটা কঠিন। সাক্ষাতকারগুলো শেষ হওয়ার পর আমি দৌড়িয়ে বাসায় আসতে চাইতাম এই চিন্তা করে যে, কত তাড়াতাড়ি বইতে অ্যাড করব!

সাক্ষাতকার নেওয়া ব্যক্তিগুলোর কাছে পৌছা আমার জন্য প্রথমে অনেকটা স্বপ্নের মত ছিল। বিশেষ করে দলের তিনজন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম মেম্বারের। আল্লাহর শুকরিয়া যে, খুব সহজেই পৌছতে পেরেছি। আর উনাদের আচরনে উদারতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মন খুলে প্রশ্ন করতে সহজ করে দিয়েছে। মোটেই ইত:স্তত হয়নি কোন বিষয়ে এ ধরনের প্রশ্ন করতে যে, আপনাদের এই কাজটি ভুল ছিল কিনা? এ ঘটনায় আপনারা এমন না করলে হত কিনা? কিংবা এ কাজগুলো কেন করেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

বইয়ের অনেকগুলো পৃষ্ঠা লিখতে গিয়ে কখনো খুববেশী আবেগে আপ্লুত হয়েছি কখনোবা কষ্ট পেয়েছি আবার কখনোবা আনন্দিত হয়েছি। বিশেষ করে ১৫ জুলাই ক্যু চ্যাপ্টার লিখতে গিয়ে লেপটপের বাটনগুলোতে হাত থেমে যেত, গা শিরশির করে উঠত আর চোখে ভারি হত আবেগের জলে।

আবার যখন লিখতে টায়ার্ড হয়ে যেতাম/ কিংবা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়তাম তখনই এরদোগানের বক্তব্য শুনতাম। বিশেষ করে যুবকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যগুলো। যেগুলো আমাকে পুরোপুরি তাজা করত এবং লিখতে উৎসাহ দিত। সবমিলে এরদোগানের কয়েকশত বক্তব্য ও সাক্ষাতকার শোনা হয়েছে যেগুলো শুধু বইতে ব্যবহার করেছি তাই নয় বরং সারাজীবনের বড় এক সম্পদ হয়ে থাকবে।

সবমিলে ডিসেম্বর মাসে এসে বইয়ের কাজ শেষ করি। শেষ পাঁচ-ছয়মাস প্রায় সারারাত কাজ করেছি। তখন শাশুড়ি এখানে (তুরস্কে) ছিলেন। আমার ছোট বাচ্চা, তার মা এবং উনি একরুমে থাকতেন আর আমি পাশের রুমে বসে লিখতে থাকতাম। সত্যিই খুব কম সময় দিতে পেরেছি উনাদেরকে। আর তাই বউ আমাকে প্রায়ই বলতেন, বাসার ভাড়াটিয়া!! মানে হল ভাড়াটিয়ারা যেমন বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় মালিকের সাথে দেখা করে আমিও তেমনি শুধু খাওয়ার সময়গুলোতে একসাথে হতাম।

আল্লাহর শুকরিয়া, বইটি শেষ করতে পেরেছি। আপনাদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। আসলে অনেকগুলো প্রিয় মানুষ বই লিখার পিছনে শ্রম দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন যাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করা যাবেনা।

সকলের দোয়া চাই, আগামীতে যেন আরো বেশি করে লিখতে পারি। আল্লাহ যেন লেখার হাতকে আরো শাণিত করেন।

Check Also

গাজায় আরও ৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজা ভূখণ্ডে আরও ৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।