স্টাফ রিপোর্টার : আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ৭ মার্চের এই ভাষণের মাধ্যমেই তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে উজ্জিবিত করেছিলেন। এ কারণে ই এই ভাষণকে প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আর এই স্বীকৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায় ক্ষমতাশীনরা। স্মরণকালের বড় সমাবেশ করতে ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছে বায়লাদেশ আওয়ামী লীগ। দিনটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
সুদীর্ঘকালের আপসহীন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে গত বছরের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।
বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসলেও জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতিতে উজ্জীবিত জাতি এবার দিনটি ভিন্নমাত্রায় উদযাপিত করবে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
অপর এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, আসুন সবাই মিলে একটি অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। প্রতিষ্ঠা করি জাতির পিতার স্বপ্নের ‘ সোনার বাংলা’। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
সেদিন ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সব মিছিলই এসে থামছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্স রূপ নেয় জনসমুদ্রে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখো মানুষে কানায় কানায় ভরে যায় বিশাল ময়দান। বাতাসে উড়ছে বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। আকাশে উত্থিত বাঁশের লাঠির সঙ্গে লাখো কণ্ঠের স্লোগানে কেঁপে উঠছে জনতার উর্মিমালা। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৩টা ২০ মিনিট সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতকাটা কালো ‘জহর’ কোট পরে বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। ফাল্গুনের সূর্য তখনো মাথার ওপরে। বঙ্গবন্ধু দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। আকাশ কাঁপানো স্লোাগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে। তারপর শুরু করলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আপনারা সকলে জানেন ও বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। ভাষণ চলছে। গগণবিদারী স্লোগানে কেঁপে উঠছে চারপাশ।
অনধিক বিশ মিনিটের এই ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে আনেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সংবলিত চার দফা দাবি সেদিন উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দরাজ গলায় বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা’। ওই ভাষণের শেষ শব্দটা ‘জয় পাকিস্তান- ছিল বলে অনেকে তথ্য দিলেও আওয়ামীলীগ ও তার মিত্ররা তা মানছে না।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, ‘আমি বলে দিতে চাই- আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।
দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আগামীকাল ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকাল ২টায় ৭ মার্চের ভাষণের স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন।
এবারের সমাবেশ কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। তিন কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে শোডাউনের দিকে নজর দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রথমত, বিএনপি যাতে মাঠে নামার সাহস করতে না পারে ও তাদের মনোবলে চিড় ধরানো যায়, দ্বিতীয়ত, জনগণের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের যাতে ঘনিষ্ঠ সেতুবন্ধন তৈরি হয় ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরা যায় এবং তৃতীয়ত, দলের সব পর্যায়ের নেতাকে কাজের মধ্যে যুক্ত রাখা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এমন তথ্য জানান।
তারা জানিয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে এটা আওয়ামী লীগ চায়। তবে বিএনপি যাতে কোনোভাবেই সংগঠিত হতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখছে তারা। মূলত অসংগঠিত বিএনপিকে নির্বাচনে দেখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। দলের শীর্ষ নেতারা জানান, বিএনপি মাঠে নামার চেষ্টা করছে। বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হলে আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতেই শোডাউন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, ঢাকাসহ সারাদেশে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত যেকোনও কর্মসূচিতে সরব থেকে, মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করে দলের শক্তিশালী অবস্থান জানান দেওয়ার জন্যে শীর্ষপর্যায় থেকে ইতোমধ্যে দলের সর্বস্তরে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভাগীয় সফরেও শোডাউনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর এসব জনসভায় মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে কর্মিসভা, যৌথসভাসহ নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এগুলো কেন্দ্রীয় নেতারাই দেখভাল করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, কর্মসূচিকে ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম ঘটানো প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কৌশল। আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে ৭ মার্চের কর্মসূচি নিয়ে লোকসমাগম ঘটানোর ব্যাপক প্রস্তুতির কারণ হলো, এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। দিনটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় এদিনের কর্মসূচিতে শোডাউনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, এর মধ্যদিয়ে বিএনপি চাপে পড়বে, মাঠে দাঁড়ানোর সাহস হারাবে। বিএনপির নেতাকর্মীরা মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। আর এটি আগামী নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের জন্য সুফল বয়ে আনবে। এসব বিবেচনায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কর্মসূচিতেও মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্যে শহরজুড়ে মাইকিং, পোস্টারিং এমনকি রাজপথে হেঁটে হেঁটে লিফলেট পর্যন্ত বিতরণ করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দন্ডিত হওয়ার পর বিএনপি মাঠে আসার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছুটা ছাড় পেয়ে গেলে তারা হুট করে মাঠে নেমে যাবে। তাদের ঠেকাতে হলে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে মাঠে থাকতে হবে। এজন্য আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে শোডাউন প্রদর্শন করার কোনও বিকল্প নেই। তাতে বিএনপি মাঠে নামার সাহস দেখাবে না। আর কখনও মাঠে নামার সুযোগ হলেও কর্মসূচি সফল করতে পারবে না তারা।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার দন্ডের পর ৭ মার্চের কর্মসূচিতে স্মরণকালের সর্বোচ্চ লোকসমাগম করে বিএনপিকে বার্তা দিতে চায় জনগণও আওয়ামী লীগের পক্ষে রয়েছে। ৭ মার্চের কর্মসূচি ঘিরে প্রতিদিনই রাস্তায় লিফলেট বিতরণ করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, আগামী দিনগুলোতে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে আমরা আরও ব্যস্ত হবো। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি মানে কত লোক হলো বা না হলো– সেই বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ফলে কর্মসূচিগুলোতে লোকসমাগমের প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকেই।
আওয়ামী লীগের সকল শাখা কমিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণ করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য সংগঠনের সকল স্তরের নেতা-কর্মী এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।