ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:শ্রীলঙ্কান মুসলিম নারী ফাতিমা জামির আল জাজিরাকে বলেছেন- ‘আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমার ঘরের সব দরজা-জানালা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আমার পুরো বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয় হয়েছে।’ ২৭ বছর বয়সী শুকরি কাসিম যার চারটি বেডরুম তছনছ করা হয়েছে। তিনি বলেন- আমরা আক্রান্ত, নিরাপদে নেই। আমাদের শিশুরা ভীত-সন্ত্রস্ত। আমরা জানি না কোথায় যাব। কে আমাদের বিশ্বাস করবে। আমরা জানিনা কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। যারা চালাচ্ছে তাদের চিনি না। তবে তাদেরকে স্থানীয়রাও সহায়তা করছে, তারা শুধু মুসলমানদের বাড়ি-ঘরই ধ্বংস করছে।
কান্দি জেলায় মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসকভাবে ভালো। স্থানীয়রা জানায়- ধর্মীয় উৎসবে তারা খাবার ভাগাভাগি করে খায়, একসাথে খেলা করে, একই দোকান থেকে কেনাকাটা করে। একজন গবেষক বলেন- এসব আক্রমণ সুপরিকল্পিত, সুসংঘটিত।
গত বছর থেকেই শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। কয়েকটি কট্টরপন্থি বৌদ্ধ গোষ্ঠী অভিযোগ করে আসছিল, শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি বৌদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক স্থানগুলো ভাংচুরের জন্যও তারা মুসলমানদের দায়ী করে আসছিল। গতবছরের শেষে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে মুসলমান রোহিঙ্গারা শ্রীলঙ্কায় গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করলে তাতে আপত্তি জানিয়ে সরব হয় দেশটির কয়েকটি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী।
বৌদ্ধ তরুণের মৃত্যুর জের ধরে সোমবার ক্যান্ডিতে মুসলমান মালিকানাধীন একটি দোকানে অগ্নিসংযোগের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী বৌদ্ধদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ব্যাপক সংঘাত শুরু হয়। দাঙ্গা থামাতে ক্যান্ডিতে সান্ধ্য আইন জারি করে সেখানে সেনা ও এলিট পুলিশ ফোর্স পাঠায় সরকার। মধ্যাঞ্চলীয় ক্যান্ডি শহরে সপ্তাহ খানেক আগে গাড়ি সংক্রান্ত এক বিরোধের জেরে মুসলিমরা বৌদ্ধ এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করেছে- এরকম একটি অভিযোগের পর সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গত সপ্তাহে আমপারে শহরেও মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে হামলা চালানো হয়।
কিছু কিছু এলাকায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সিনহালারা মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সোমবার সেখানে পরিস্থিতি গুরুতর রুপ নিলে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু পরে সেটি কিছু সময়ের জন্যে তুলে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২৪ বছর বয়সী এক মুসলিম তরুণের মৃতদেহ পাওয়ার যাওয়ার সাথে সাথেই সেখানে আবার সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মসজিদ, বাড়িঘর, দোকান এবং গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, সবকিছু ভেঙে ফেলা হয়েছে, মুসলিমরা এখন সেখানে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে। মার্চ ২০১৮ রবিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত ১০টি মসজিদ, শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুইজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি বাড়ির পাশে মুসলিম এক তরুণের মরদেহ উদ্ধারের পর সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। মুসলিমরাও প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলা চালাতে পারে এই আশঙ্কায় পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ দিনের জন্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও ফেসবুকের মতো সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যারা এধরনের সহিংসতায় উস্কানি দেবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে মুসলিমদের ওপর হামলা ও সহিংসতা ঠেকাতে আরো সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। পুলিশ দাঙ্গা থামাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলাকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারগ্যাস ছুড়েছে।
কান্দিতে সেনাবাহিনী ও এলিট পুলিশ মোতায়েন করার পরও মুসলমানদের ওপর উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের হামলা ও সহিংসতা থামেনি। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো পোস্ট দিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা করার আহবান জানানো হচ্ছে। এসব উস্কানিতে উগ্রপন্থি তরুণরা উৎসাহিতও হচ্ছে। কোথাও কোথাও আক্রান্ত মুসলমানরাও সংগঠিত হয়ে হামলার বদলা নিচ্ছে।
সংবাদ মাধ্যমগুলো দেশটির সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানায়, মুসলিম-বৌদ্ধ সহিংসতার উস্কানি ঠেকাতে শ্রীলঙ্কার টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (টিআরসি) ফেসুবুক, টুইটার, ভাইবার, হোয়টসআপসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক আগামী তিনদিনের জন্য বন্ধ রাখবে। দেশটি ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এই দাঙ্গার ঘটনাকে ঘিরে সরব হয়েছেন দেশটির সাবেক ক্রিকেটাররা। সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা টুইট বার্তায় এ ধরনের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বা ধর্মীয় অবস্থানের কারণে কোন মানুষ হামলা বা হুমকির শিকার হতে পারে না। সেখানে বর্ণবিদ্বেষ বা সহিংসতার কোন স্থান নেই। সবাইকে জোরালভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সাবেক অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে টুইট বার্তায় বলেন, ‘আমি সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি জাতি/ধর্ম যাই হোক না কেন, সবার জন্য ন্যায়বিচার চাই। আমি ২৫ বছর ধরে চলা একটি গৃহযুদ্ধের মধ্য বড় হয়েছি, তাই চাই না যে, পরের প্রজন্মও তেমন একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাক।’
সাবেক অধিনায়ক সনাৎ জয়াসুরিয়া বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় সহিংসতার ঘটনা দেখে ঘৃণা ও হতাশ লাগছে। আমি দৃঢ়ভাবে এর নিন্দা করি এবং জড়িত অপরাধীদের ন্যায়বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই। আমি শ্রীলঙ্কান জনগণকে এই কঠিন সময়ে একসাথে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’
অলরাউন্ডার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ বলেছেন, ‘আমরা শ্রীলঙ্কানরা তিন দশক একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা ভোগ করেছি। এসময় অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। যার ফলে অনেক প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন তাত্ক্ষণিকভাবে বিদীর্ণ হয়েছে। আমার এবং আমার পরিবারসহ অনেকেই রাস্তায় হাঁটতে ভয় পাচ্ছে এবং অনিশ্চয়তা মধ্যে রয়েছে।’আল জাজিরা ও বিবিসি