অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, ব্যবহারকারী যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীও হন তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে এলে সাধারণ মানুষসহ সর্বত্র সরকারের ইমেজ বাড়বে। প্রকৃত অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে কঠোর মনিটরিংয়ের প্রয়োজন।
এখানে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন। নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ে এটাও তো সবার জানা। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থেই র্যাব-পুলিশসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া দরকার।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সীমান্তের কোন কোন এলাকা দিয়ে অস্ত্র ঢুকছে তা আমরা জানি। তবে ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে অস্ত্র ঢুকছে তা তো বলা যায় না। তবে র্যাবের প্রতিটি সদস্য এ বিষয়টিতে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিয়ে কাজ করছেন। কারণ, র্যাব সৃষ্টির সাতটি ম্যান্ডেটের মধ্যে অস্ত্র অন্যতম। ’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ৩৫ জেলায় ৪৬২ জন অস্ত্র ব্যবসায়ী সক্রিয়। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৪, চট্টগ্রামে ৪৮, ঢাকায় ৩৪, বান্দরবানে ২৬, কক্সবাজারে ২০, কুমিল্লায় ২০, মেহেরপুরে ১৮, নারায়ণগঞ্জে ১৩, টাঙ্গাইলে ১৪, সাতক্ষীরায় ১৪, রাজবাড়ীতে ৮, ফরিদপুরে ৪, গোপালগঞ্জে ৫, নেত্রকোনায় ১০, শেরপুরে ১৩, সিলেটে ১০, সুনামগঞ্জে ৮, হবিগঞ্জে ৮, খুলনায় ২, যশোরে ১১, নড়াইলে ৬, ঝিনাইদহে ৪, চুয়াডাঙ্গায় ১৩, কুষ্টিয়ায় ১১, রংপুরে ৪, লালমনিরহাটে ৫, দিনাজপুরে ৯, রাজশাহীতে ১২, নাটোরে ৬, নওগাঁয ২, জয়পুরহাটে ১৫, বগুড়ায় ৪, ফেনীতে ১২, খাগড়াছড়িতে ৮, ও রাঙামাটিতে রয়েছেন ১১ জন। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১১২, বিএনপির ৬৫, জামায়াতের ৮, জাতীয় পার্টির ২, ইউপিডিএফের ৯, জেএসএসের ২২, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ৭, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় ২০০, সুবিধাবাদী ৩৭ জন।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন ১৩৯ জন প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ৭৮, বিএনপির ৪১, জামায়াতের ৪, জেএসএসের ২ ও সুবিধাবাদী ১৪ জন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে গুলিবিদ্ধ হন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আশফাক আল রাফী শাওন (২৮)। টানা ১১ দিন মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। এর কিছু দিন আগে ৯ জানুয়ারি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি বাজারে শাকিল (২১) নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। শাকিল উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের লদের বাড়ির আবুল হাসেম খোকা মিয়ার ছেলে। ওপরের দুটি ঘটনাসাম্প্রতিক কালে অস্ত্রের ঝনঝনানির বিষয়টি নতুন করে ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেক এলাকাতেই দেখা যায় তুচ্ছ ঘটনায় অস্ত্র প্রদর্শন। ঘটছে খুন-খারাবির মতো ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে বৈধ অস্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ কর্মকাণ্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘সরকার হয়তো আন্তরিকভাবেই চায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান অস্ত্র আইনও যথেষ্ট শক্ত। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই শুনি অস্ত্রধারীরা কিছু দিন পর জামিনে বের হয়ে পুনরায় আগের অপরাধে জড়াচ্ছে। অপরাধী দলীয় নেতা-কর্মীদের আইনের আওতায় নিয়ে এলে সরকারের ইমেজ বাড়বে বই কমবে না। ’
২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিনাজপুর হিলি স্থলবন্দরসংলগ্ন ধরন্দা গ্রাম থেকে একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন, সাত রাউন্ড গুলিসহ বিজিবির লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী গোলাপ হোসেনকে (৪৫) গ্রেফতার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি দল। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (এল আই বিজিবি) মো. গাওহারুল ইসলাম ও বাদী বিজিবির সুবেদার মো. আবদুল মান্নান হাকিমপুর থানার ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ৮ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের বিচারক এনায়েতুর রহিম ও সহিদুল করীমের আদালত তদন্তে গাফিলতির জন্য আইওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের আদেশ দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ হোসেন। একই সঙ্গে লাইনম্যান গোলাপের জামিন বাতিল করা হয়েছে। তদন্তে অবহেলার কারণে এ রকম অস্ত্র মামলা চাপা পড়ে যাওয়ার নজির রয়েছে।
গত বছরের ১ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি দল নয়টি পিস্তল, একটি শুটারগান, ১০ রাউন্ড গুলি, নয়টি ম্যাগজিনসহ যশোরের চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী আলাউদ্দীন ওরফে আলাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, মাদকসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আলা যশোরের ক্ষমতাসীন এক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠজন। সীমান্ত এলাকায় তার মাধ্যমে অনেক চোরাচালানের কাজ করিয়ে থাকেন তিনি। আলার সরবরাহকৃত অস্ত্র জঙ্গিদের হাতেও পৌঁছেছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি ক্রাইম) রৌশন আরা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান তো আমাদের একটি রুটিনওয়ার্ক। রুটিনওয়ার্কেও মাঝেমধ্যে বড় ধরনের সাফল্য আসে। তবে মাঠপর্যায়ে কোনো ইউনিট যদি প্রয়োজন অনুভব করে তখন সেখানে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সে ক্ষেত্রে তারা পুলিশ সদর দফতরকে অবহিত করেই অভিযান পরিচালনা করে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে নির্বাচনকেন্দ্রিক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানও অনেকটা রেগুলার ওয়ার্ক। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন থেকেও পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়। ’ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘মামলার এজাহার ও চার্জশিটের দুর্বলতা এবং গাফিলতির কারণে অনেক ক্রিমিনাল আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে রয়েছে। অনেক সময় বড় বড় ঘটনায় ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পরিকল্পনামাফিক আবার অনেকের অজ্ঞতার কারণেই তা ঘটেছিল। ’ পুলিশ সদর দফতর বলছে, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৪৭টি অস্ত্র, ১৯ হাজার ৫৬টি গুলি, ৩ হাজার ৯৯২টি কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে। ২ হাজার ৩টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৪ জনকে। আদালত সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন জজ আদালতে বিচারাধীন ৫ হাজার ৩৫৬টি অস্ত্র মামলা রয়েছে। রয়েছে ৫৫টি তদন্তাধীন মামলা। গত নভেম্বরে রাজধানীতে অস্ত্র মামলার সংখ্যা ১৫টি। এর ঠিক আগের মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১২টি। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে গোপনে একটি চক্র অস্ত্রের নম্বর টেম্পারিংয়ের কাজ করে যাচ্ছে। নিখুঁত ওই টেম্পারিংয়ের কারণে কিছুসংখ্যক অস্ত্রের লাইসেন্সধারী তাদের লাইসেন্সকৃত প্রকৃত অস্ত্রের নম্বর ঠিক একই মডেলের অন্য অবৈধ অস্ত্রের ওপর বসিয়ে দিচ্ছেন। এতে একটি লাইসেন্সের বিপরীতে তারা কয়েকটি অস্ত্র ব্যবহার করতে পারছেন বলে খবর রয়েছে