নির্বাচনী আচরণ বিধি :
* নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ পূর্বে নির্বাচনী প্রচার চলবে না।
* সরকারী সুবিধাভোগী ব্যক্তি সরকারী যানবাহন ও প্রচার যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না প্রচারে।
সরদার আবদুর রহমান : দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় বেশ দেরি থাকলেও ক্ষমতাসীনদের আগাম নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে বিতর্ক বেড়ে চলেছে। এনিয়ে আইনগত ও নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে।
সারা দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকায় ভোট চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তি ও নির্বাচনী প্রতীকের নামে সমানে ব্যানার, সম্ভাব্য প্রার্থীর ছবিসহ রঙিন পোস্টার, দেয়াল লিখন প্রভৃতির মাধ্যমে জোরদার প্রচার-প্রচারণা। আগামী কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিতব্য কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে মহানগরীগুলোতে এই প্রচারণা এখনই তুঙ্গে তুলে দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। যা নির্বাচনী আইন-বিধি ও নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। কিন্তু এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে প্রশ্ন : নির্বাচনের কোন ঘোষণা না থাকলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করা শুরু করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি সংক্রান্ত বিধিবিধানে দেখা যায় আগাম নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই। বলা হয়েছে, ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করিতে পারিবেন না।’ (বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮, ক্রমিক ১২)। অপর এক বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ উল্লেখ্য, এখানে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর পদ উল্লেখ রয়েছে। (বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ২৪ নবেম্বর ২০১৩, ক্রমিক ১৪)। ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ অর্থ- প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চীফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধী দলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাহাদের সমপদমর্যদার কোন ব্যক্তি, সংসদ-সদস্য এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র’। (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর ২৪, ২০১৩)।
নির্বাচনী আইনে ‘সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনী প্রচারণা’ শীর্ষক বিধিতে বলা আছে, (১) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকা- যোগ করিতে পরিবেন না। (২) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার অন্যবিধ সরকারি সুবিধাভোগ করিতে পারিবেন না এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকারি আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা- কর্মচারি বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর, ২৪, ২০১৩)
‘সরকারি সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যক্তির নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত বাধা নিষেধ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘সংসদের কোন শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে সরকারের কোন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী কিংবা উক্ত মন্ত্রীদের পদমর্যাদাসম্পন্ন সরকারি সুবিধাভোগী কোন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন-পূর্ব সময়ের মধ্যে কোন সফর বা নির্বাচনী প্রচারণায় যাইতে পারিবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত নির্বাচনী এলাকায় ভোটার হইলে তিনি কেবল ভোট প্রদানের জন্য উক্ত এলাকায় যাইতে পারিবেন।’ (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০০৮)।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনী আচরণবিধিতে উল্লিখিত ‘ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করিতে পারিবেন না’- এই বিধানকে পছন্দমত বাখ্যা করে এর সুযোগ নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের মতে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরই কেবল এই বিধি-বিধান কার্যক্রম হবে। তার আগে এর কোন কার্যকারিতা নেই। ফলে সরকারি সুবিধার অবাধ ব্যবহার করে নির্বাচনের এক-দেড় বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের আগেই বিশেষ প্রতীকের পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে। যা প্রবল অনৈতিকতার পরিচায়ক বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু করে বলেন, এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরান (র.)-এর পূণ্যভূমি সিলেট থেকে আমরা নির্বাচনী প্রচার শুরু করছি। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য আমি আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।’ এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে একতরফা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।
অন্যদিকে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা দূরের কথা, সাধারণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিই পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশের কোন অনুমতি তো মিলছেই না, সাধারণ অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন, কালোপতাকা প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, পোস্টার লাগানো প্রভৃতি অনুত্তেজক ও নিরীহ কার্যক্রমে হামলা চালানো হচ্ছে। লাঠিপেটা করে কর্মসূচি ভ-ুল করে দেয়া হচ্ছে। মানববন্ধনে ঢুকে নেতাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পোস্টার লাগানোর সময় আটক করা হচ্ছে। পোস্টার তুলে ফেলা হচ্ছে। এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে বিএনপির কয়েকশ’ নেতাকে গ্রেফতার করার কথা জানা গেছে।
এবিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভোট চাইতে পারেন- কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে ভোট চাইতে হবে। মওদুদ বলেন, যদি প্রধানমন্ত্রী নিজের খরচে জনসভা করেন, তাতে কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু সরকারি খরচে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভোট চাইতে পারেন না। গত ৯ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি ভোট চান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে। এ সময় সরকারি গাড়ি নেবেন না, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সভায় আনবেন না, নিরাপত্তা থাকবে না। বিধি মেনে আপনি করুন, আপত্তি নেই। আর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে যদি আপনি ভোট চাইতে যান, তাহলে বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়াকেও ভোট চাইতে দিতে হবে। একই অধিকার দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এভাবে কী করে ভোট চাইতে পারেন, বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘একদিকে প্রধানমন্ত্রী ভোট চাইছেন, অপরদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে। এটা তো অন্যায়, অনৈতিক ও বেআইনি।’ নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ইসি বলছে, তফসিল ঘোষণার পরই তাদের নাকি কর্তৃত্ব। তারা এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকা-ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারকে একটি চিঠি দিতে পারেন না? ইসি সরকারকে বলুক, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ প্রচার বন্ধ করুন। আর তা না হলে খালেদা জিয়াকেও একই সুযোগ দিন।’ অপর এক স্থানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, এতসবের পরও নির্বাচন কমিশন বলছেন তাদের এবিষয়ে কিছু করার নেই। আসলে তাদের শক্তি নেই। তারা নিরপেক্ষ নয়। তারা সরকারের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠান। সেজন্য তারা এই ধরনের কথা বলছেন। নির্বাচনের এত আগে ভোট চাওয়ার এই ঘটনা যদি আজকে ভারতে হতো তাহলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতো। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হয় সরকারি খরচে ভোট চাওয়া বন্ধ করুন অথবা আমাদেরও ভোট চাওয়ার সুযোগ করে দেন।’
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …