যেভাবে পুলিশী হেফাজতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় কাশ্মীরবাসী

 আলজাজিরা : নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যাকাণ্ডের এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হাজির রয়েছে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। আল জাজিরার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯০ দশকের শুরুতে যখন সেখানে স্বাধীনতা/স্বশাসনের দাবিতে বিদ্রোহ ডানা মেলতে শুরু করে, তখনই এই ধরনের খুনের ঘটনা ছিল সর্বোচ্চ। স্থানীয়দের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করার নজির রয়েছে সেখানে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী সুভাষ ভামরে আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, কাশ্মীরের রাজ্য সরকার ৫০টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা জানালেও ৪৭টি ঘটনায় কোনও বিচার হয়নি। বাকী ৩টির বিচার কার্যক্রম চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে ব্যবহৃত ভবনগুলোকে স্থানীয়রা ‘নির্যাতন চেম্বার’ বলে ডাকে। আল-জাজিরা রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও জিজ্ঞাসাবাদে ব্যবহৃত এমন ভবনের সংখ্যা জানতে পারেনি। কীভাবে পুলিশি হেফাজতে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়; ফায়াজ নামের এক কাশ্মীরী তরুণকে হত্যার ঘটনার বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে তা তুলে আনার চেষ্টা করেছে আল জাজিরা। নির্যাতন চালিয়ে ফায়াজকে হত্যার পর কী করে তাকে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়; তা উঠে এসেছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে।

২৪ বছর বয়সী ফায়াজ আহমেদ শাহ। ১৯৯০ সালে যোগ দেন স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহতে। তখনই পুলিশ আটক করে তাকে। ৯০ দশকে কাশ্মিরি প-িতদের পরিত্যক্ত বেশ কিছু বাড়িকে রূপান্তর করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে। ফায়াজকে আটকের পর তেমনই এক বাড়ি,  বিএসএফের কুখ্যাত জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র পাপা টুতে  নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ফিরে আসে ফায়াজ। কথিত আছে সেখান থেকে কেউ জীবিত ফিরে আসতো না। তবে ফায়াজ সৌভাগ্যবান ছিল সেবারের মতোন। প্রাণ হারাতে হয়নি তাকে। প্রচ- নির্যাতন সহ্য করে ফিরে এসেছেন।  ১৯৯৬ সালে নির্যাতন কেন্দ্রটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ওই জায়গাটি জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সরকারি বাসভবন।

সেবার নির্যাতন কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফায়াজের ঠাঁই হয় জম্মু কেন্দ্রীয় কারাগারে। ফায়াজের ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ শাহ আল জাজিরাকে জানান, ‘সে সময় সন্ত্রাসবিরোধী আদালত কারাগার প্রাঙ্গণেই বসতো। তারা আমার ভাইকে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে জামিন মঞ্জুর করেন।’মুক্তির পর ফায়াজ নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। তার বয়স তখন ২৩। জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন মুরগির খামার। ফায়াজের চোখে তখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তবে হঠাৎ করেই যেন সাজানো জীবন তছনছ হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে আর রক্ষা পাননি তিনি। তার ভাই ইমতিয়াজ  ২০ জানুয়ারি তারিখের সেই স্মৃতি থেকে বলেন,  ‘সকাল সাড়ে ছয়টা। ঘটনাস্থল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বারজুলা ভগত এলাকা। সেখানে অবস্থান নিয়েছে দোর্দান্ত প্রতাপের ভারতীয় সেনাবাহিনী। কাছেই এক মসজিদ থেকে ঘোষণা এসেছে প্রতিরোধের। পুরুষদের বলা হয়েছে, তারা যেন পুলিশ স্টেশনের পেছনে অবস্থান নেয়।’ইমতিয়াজ জানান, ‘আমরা তখন ঠা-ায় কাঁপছি। সেনাবাহিনী আমাদের আইডি কার্ড পরীক্ষা করছেন। এমন সময় আমার ২৪ বছর বয়সী ভাইকে আটক করে সেনাসদস্যরা।’ ইমতিয়াজ বলেন, ‘তার নাম ফায়াজ আহমাদ শাহ। কিন্তু খুব কম লোকই তার পুরো নাম জানতো। সবাই তাকে ফায়াজ বক্সার বলেই চিনতো।’

১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিটি গারহোয়াল ব্যাটালিয়ন তাকে আটকের পরই খবর ছড়িয়ে যায় যে তাকে জাহাঙ্গীর কলোনির জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে অভিযোগ করেন তার ভাই ইমতিয়াজ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী সুভাষ ভামরে বলেন, রাজ্য সরকার এমন ৫০টি ঘটনার কথা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে। এর সবগুলোই ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঘটনা। কিন্তু ২০০৬, ২০১১ ও ২০১৪ সালে তিনটি কেস নিয়ে কার্যক্রম চললেও ৪৭টিরই কোনও বিচার হয়নি।  ২০১৪ সালে সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল, একজন ক্যাপ্টেন ও তিনজন সদস্য কাশ্মিরি বেসামরিক হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হন। কিন্তু ২০১৭ সালের জুলাইয়ে আর্মি ট্রাইব্যুনালে তাদের সাজা বাতিল করা হয়। নিহত বেসামরিকদের বিদেশী সেনা বলে দাবি করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাজ্যসভার প্রশংসা করে বলেন, মূলত পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবেই এই বিচারকাজগুলো করা যাচ্ছে না। আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ক্ষমতার চর্চা করেন। ওয়ানি বলেন, যদি সামরিক আদালতেও কোনও সেনা দোষী সাব্যস্ত হয়ে তবে তারা দিল্লিতে আর্মড ফোর্সেস ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু নির্যাতনের শিকার কেউ এই আদালতে যেতে পারেন না এবং তাদের বক্তব্য রাখতে পারেন না।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জাহুর ওয়ানি বলেন, সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা খুবই কঠিন। সেখানে কোনও রেকর্ড নেই। বেশিরভাগ কেসই নিবন্ধন করা হয়নি। কেউই আদালতে যাননি কারণ তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। সবসময়ই নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগতেন তিনি। তিনি বলেন, ৯০ এর দশকে পুলিশ এতটাই বেপরোয়া ছিলো যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তাদের পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে যেত তারা।  কাশ্মীর লাইফের সাংবাদিক মুহাম্মদ রাফি বলেন, ২০০০ সালের শুরু পর্যন্ত এই চর্চা অব্যাহত ছিল। ২০০৪ সালের এক ঘটনা টেনে তিনি বলেন, ‘সেসময় বান্দিপোরায় পাপচান গ্রামে আমাদের কেএমডি বাসটি থামিয়েছিল সেনাসদস্যরা। তারা হাত দিয়ে আমাদের হৃদস্পন্দন বোঝার চেষ্টা করছিল। একজনের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ায় তাকে আটক করে সেনাবাহিনী।’ জেএন্ডকে সৈনিক স্কুলের শিক্ষক বলে, ৯০ এর দশকে টর্চ ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। কারণ এর মধ্যে করে বোমা নেওয়া যায় বলে দাবি তাদের। যদি অন্ধকারেও কেউ টর্চ জ্বালায় তবে তাকে তুলে নিয়ে যেত সেনাবাহিনী। আর একবার তুলে নিয়ে গেলে তিনি জীবিত ফিরে আসবেন কি না সেই বিষয়ে সংশয় ছিল।

ফায়াজকে কেন আটক করা হয়েছিল? তার ভাই ইমতিয়াজ মানতে নারাজ যে ফায়াজকে তার অতীতের জন্যই আটক করা হয়েছিল। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, সেনাসদস্যরা তার অতীত জানতো না।  জম্মু-কাশ্মীরের বিখ্যাত আইনজীবী নাসির কাদরি বলেন, আটকের কারণ সবসময় রহস্যময় হয়। ৯০ দশকের শুরুর থেকেই তারা আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এখনও এই অবস্থাই চলছে। চেকপয়েন্টে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে, কিংবা তাদের পোশাকের কারণে সাধারণ মানুষকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯৯৪ সালের ২০ জানুয়ারি, বিকাল ৪টার দিকে নিজের কাচেরপোরায় ফায়াজের বাড়ির সামনে তার মরদেহ ফেলে যায় সেনাবাহিনী। আর এই ভয়ংকর দৃশ্য একাই দেখেন তার অসুস্থ মা। সবাই তখন ফায়াজের মুক্তি নিয়ে ব্যস্ত। এই ভয়ংকর দৃশ্য চোখের সামনে দেখে চিৎকার করে উঠেন মা, ঝাপিয়ে পড়েন সেনাদের ওপর। ‘তারা কোনও দয়া মায়া দেখায়নি। ঘুষি মেরে মায়ের দাঁত ভেঙে দেন তারা।’ একরাশ কষ্ট নিয়ে বলছিলেন ইমতিয়াজ। ২১ জানুয়ারি ফায়াজের ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু এটি সংগ্রহ করতে ‘আকাশ-জমিন এক করে’ ফেলতে হয়েছিল ইমতিয়াজদের। শেষ পর্যন্ত শ্রীনগর টাইমসে মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদকে খেলা চিঠি লেখার পর ২০০৩ সালে সেই রিপোর্ট হাতে পান তারা। গারওয়াল ব্যাটালিন তাদের সঙ্গে সামরিক ডাক্তার এনেছিলেন। তিনি ঘোষণা দেন বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোনও ডেথ সার্টিফিকেট নেই তার। ইমতিয়াজ বলেন, আমাদের বলা হয়েছে যে ফায়াজ বিষপান করেছেন। মিউনিসিপাল থেকে এমনই ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে আমাদের। আর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমরা হাতে পেয়েছি ৯ বছর পর। চাপ প্রয়োগের পর ইমতিয়াজকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে তলব করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় ফায়াজের মেডিক্যাল রিপোর্ট কে তৈরি করেছিল। ইমতিয়াজের স্পষ্ট জবাব ছিলো ‘জিএন ভাট’ তিনি তখন রাজ্যের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে একজন। ভাট তাকে সার্টিফিকেট দেন। কিন্তু স্বাক্ষর করেন আগের তারিখের। তিনি মানতে চান না ১০ জুন, ২০০৩ সালে এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য পাওয়াটাই তখন বড় সাফল্য। এটা নিয়ে রাজ্যের মানবাধিকার কমিশেনে আপিল করেন ইমতিয়াজ। তিনি চান নিরাপত্তা হেফাজতের ভাইয়ের হত্যার বিচার। বুগদাম জেলার তৎকালীন উপ প্রশাসককে চিঠিও লেখেন তিনি। তবে আইন বিশ্লেষকরা জানান, এই মানবাধিকার কমিশন নখদন্তহীন। সামরিক বাহিনীর ওপর তাদের প্রভাব নেই। তারা শুধুমাত্র সরকারকে সুপারিশ করতে পারে।

২০০৫ সালে এসএইচআরসি ফায়াজের বিষয়ে পুলিশের কাছে এফআইআর করে। পুলিশ একে ১৭৬ ধারায় সরিয়ে দেয়। এরপর ১৭৪, যেখানে বলা হয়, নিহতরা নিজেদের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। ইমতিয়াজ বলেন, জেলা প্রশাসকের লিখিত অনুমোদন ছাড়া এফআইআর এ এমন পরিবর্তন আনা যায় না। পুলিশ নিজেদের ইচ্ছামতো সব করেছে। পুলিশের দাবি, ১৯৯৪ সালের ২০ জানুয়ারি অভিযানের সময় ফায়াজের বাড়িতে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পায় তারা। তারা দাবি করে, ‘নিহত ব্যক্তি সাবেক জঙ্গি ছিল এবং নিজ বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। তিনি হৃদরোগে মারা গেছেন, তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যা করা হয়নি। ময়নাতদন্তেও বলা হয়, হৃদরোগের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা মৃত্যু হয়েছে। ১৭৪ ধারায় নিয়ে এই কেসটি বন্ধ করা হয়েছে। কাশ্মির পুলিশের মহাপরিদর্শকের পক্ষে এই প্রতিবেদন লিখেছেন উপ-পরিচালক। ইমতিয়াজ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, পুলিশ মিথ্যা বলছেন। এতেই বোঝা যায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী কিভাবে একসঙ্গে কাজ করছে। ফায়াজের ময়নাতদন্তে দেখা যায় তার মাথায় কালো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একে হেমাটোমা বলেছেন। তবে পুলিশ কিছু জানায়নি। ফরেনসিক সাইন্স ল্যাবরেটরিতে যাওয়ার সুযোগ পাননি ইমতিয়াজ। প্রথম ময়নাতদন্তের সময়ই সব আলামত সরিয়ে ফেলা হয়। হতাশার সুরে ইমতিয়াজ বলেন, এই কাজ কিভাবে করলো তারা। নাহলে ঠিকই বেরিয়ে আসতো যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর বিষয়টি সাজানো।সর্বশেষ ২০০৭ সালে কিছুটা সান্তনা পান ফায়াজের পরিবান। সেবছর ২৬ জুন এসএইচআরসি ঘোষণা দেয় যে পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু হয়েছে ফায়াজের। মানবাধিকার সংস্থাটির বিচারক সুপারিশ করেন যেন ইমতিয়াজকে যেন সরকারি চাকরি দেওয়া হয় ও ১৫৩৪ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।  এরপর এক দশক পেরিয়ে গেছে। এখনও রিকশা চালিয়ে দিন আনে দিন খায় ইমতিয়াজ। আশায় আছেন সেই ক্ষতিপূরণের। ভাইয়ের হত্যাকা- নিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহ সবার বিচার করবেন।

Check Also

ঢাকা প্রসঙ্গে বদলাতে পারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ ডক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।