মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : উত্থান-পতন সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিন্তু সেটি ধারাবাহিক নয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হঠাৎই যেন ছন্দপতন। চার বছর আগে এমন দুর্গতি দেখা গিয়েছিল। সবাই আঁতকে উঠেছিলেন পুরনো যুগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ফিরে যাচ্ছে এমন শঙ্কায়। ২০১৪ সালে পরিস্থিতিটা এমন হয়েছিল যে সফরকারী ভারতের ‘বি’ ক্যাটাগরির দলটির বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১০৫ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। সে কারণে কোচ বদল, নেতৃত্বে বদল আনা হয়েছিল। তারপর এলো সুবর্ণ সময়। সুফল পেতে শুরু করল বাংলাদেশ ক্রিকেট। তারপর টানা সাড়ে তিন বছর স্বপ্নময় যাত্রা ছিল তিন ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ক্রমেই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের আধিপত্যের ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল টাইগাররা। বিশেষ করে দেশের মাটিতে অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মতোই হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ‘পুরনো’ সেই গা ছমছমে, ভীতিকর অবস্থার যেন শুরু হয়ে গেল নতুন বছরের শুরুতেই। ঘরের মাটিতে সফরকারী শ্রীলঙ্কার কাছে তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই যেভাবে ভরাডুবি হলো বাংলাদেশ দলের, তাতে নতুন করে যেন ‘পুরনো’ সেই চেহারায় বেরিয়ে পড়েছে। তবে আশঙ্কাকারীদের আশার আলো দেখিয়েছে মুশফিক-তামিমরা। সেই শ্রীলঙ্কাকেই নাস্তানাবুদ করে জিতল টাইগাররা। সবাই বলছে, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার এক মূল্যবান জয় এটি।
টি টোয়েন্টিতে ২১৫ রানের টার্গেট কিন্তু বিশাল। এই টার্গেটে জয়ের পরিসংখ্যান মাত্র কয়েকটি। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটিই প্রথম। থিসারা পেরেরার করা বলকে মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়সূচক রানটি নিয়েই যে মুশফিক ‘নাগিন নাচে’র মতো করে দেখালেন, সেটিই ‘টক অব দ্য ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড’ হয়ে গেছে। পুরো ক্রিকেট বিশ্বই মুশফিকের এমন জয় উদযাপন নিয়ে আলোচনায় মশগুল। মুশফিক ম্যাজিকে জয় পাওয়া গেল। তাতে স্বস্তিও মিলল। হারের বৃত্ত থেকে যে বের হওয়া গেল। এই জয় বাংলাদেশকেও যেন ছন্দে ফিরাল।
‘একটি জয় মিললেই হয়ে গেল।’ বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের কণ্ঠেই এ সুর ছিল। দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ হাতছাড়া হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ও টি২০ সিরিজে হার হয়েছে। এরপর নিদাহাস ট্রফিতে নিজেদের প্রথম ম্যাচেও ভারতের বিপক্ষে হার হয়েছে। টানা সাত ম্যাচ জয়হীন থাকার পর বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। তাতে তৃপ্তিও যেন যুক্ত হয়ে থাকল। একটি জয়ই যে দলের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। সেই জয়টি যদি আসে আবার একাধিক রেকর্ড গড়ে, তাহলে ক্রিকেটারদের জেতার ক্ষুধা কতটা ছিল; তাও টের পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার গড়া ২১৪ রান টপকে যখন বাংলাদেশ জিতে গেল তখন নিজেদের টি২০ ইতিহাসের সর্ব্বোচ্চ রান গড়ে জেতার রেকর্ডও হয়ে গেল। এই জয় এখন বাংলাদেশকে সামনের পথে ভালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই হয়। যে দলটি কখনও ১৭০ রান তাড়া করেও জিততে পারেনি। ২১৫ রানের টার্গেটেই সেই দলটি জিতে গেল। শুরুতে তামিম ইকবালের (৪৭) সঙ্গী হয়ে এদিন ওপেনিংয়ে নামেন লিটন কুমার দাস (৪৩)। দুইজনই দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখান। ৭৪ রানের জুটি গড়েন। তাতেই যেন সাফল্যের ভিত গড়া হয়। এরপর সৌম্য সরকারও (২৪) কিছুটা এগিয়ে যান। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও (২০) চেষ্টা করেন। কিন্তু আসল কাজের কাজটি করেন মুশফিক। ৩৫ বলে ৫ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতার মুশফিক।
জেতার পর যে উল্লাস করলেন, তাতেই যেন ক্রিকেটারদের মনোবল কতটা চাঙ্গা হয়ে গেছে তা ধরা পড়ল। বিধ্বস্ত দলটি যেন জেগে উঠেছে। কিন্তু কী পরিকল্পনায় এমন জয় সম্ভব হয়েছে? বাংলাদেশ ওপেনার তামিম নিজেই তা জানালেন। শ্রীলঙ্কা যখন এত বড় স্কোর করল, এরপর বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা ব্যাটিংয়ে নামার আগে কি আলোচনা করেছেন তা জানান তামিম। বলেন, ‘২১৫ অনেক বড় স্কোর। দলের সবাই বিশ্বাস করেছে, আমরা যদি পাওয়ার প্লে কাজে লাগাতে পারি আর সেটা যদি ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোয় টেনে নিয়ে যেতে পারি, যে কোন কিছুই হতে পারে। আমরা সেটাই আলোচনা করেছি। আমি-লিটন (দাস) পাওয়ার প্লে (৭৪ রান) কাজে লাগিয়েছি। মাঝের ওভারগুলোতে সৌম্য (সরকার), মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ যেভাবে ব্যাটিং করেছে, অসাধারণ। ওপরের ছয় ব্যাটসম্যান অনেক ভাল করেছে বলেই ২০০ রান তাড়া করা সম্ভব হয়েছে।’ রানের পাহাড়। তা টপকাতে হলে দ্রুত রান তোলাও জরুরী। সেই কাজটি বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা কিভাবে করল? তামিম জানিয়েছেন, ‘আমি-লিটন বলছিলাম, ক্রিকেটিং শট খেলতে থাকি। উইকেট এতটাই ভাল ছিল যে বেশি জোরাজুরি করলেই বল ব্যাটে লাগে না। যদি ক্রিকেটিং শট খেলেন, অনেক সুযোগ আসবে। আউট ফিল্ড এত ভাল, ফিল্ডারদের একটু বিট করলেই চার হয়ে যায়। সেদিক থেকে আমরা প্রথম ৬ ওভার কাজে লাগাতে পেরে অনেক খুশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইনিংসের মাঝের ওভারগুলো। প্রতি ওভারেই একটা বাউন্ডারি দরকার ছিল। ওভারে ৮-৯-১০ করে দরকার ছিল। ওই সময় মুশফিক অসাধারণ ব্যাটিং করেছে। ১০-১২ বছরের অভিজ্ঞতা সে কাজে লাগিয়েছে।’
তামিমের কণ্ঠে আবার ‘বাংলাদেশী ব্র্যান্ডে’র ক্রিকেট খেলার কথাও ফুটেছে, ‘আমাদের হয়তো বড় পাওয়ার হিটার নেই, তবে আমরা বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে পারি। আমাদের (মহেন্দ্র সিং) ধোনি নেই যে সাথে নেমে ম্যাচ শেষ করে আসতে পারে। আমাদের ক্রিস গেইল নেই যে প্রথম বল থেকেই ম্যাচ কেড়ে নিতে পারে। তবে আমাদের স্মার্ট ক্রিকেটাররা আছে। আমরা ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অনুসরণ করতে পারি না। তাদের খেলোয়াড়দের ধরন একরকম, আমাদের আরেক রকম। এই জয়টা আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাস দেবে। আমাদের কখনও ২০০ রানের ওপরে তাড়া করার রেকর্ড ছিল না। এখন থেকে খেলোয়াড়রা অন্তত বিশ্বাস করবে ১৮০ বা ২০০ তাড়া করতে পারি। সবসময়ই চার-ছক্কা মারতে হবে তা নয়। ইনিংসের মাঝের ওভারগুলো অনেক সিঙ্গেল নেয়া যায়, বাউন্ডারি আসবেই।’
২০১৬ সালে ভারতে হওয়া টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালুরুতে অল্পের জন্য হারে বাংলাদেশ। জেতা ম্যাচ হেরে যায়। সেই ম্যাচটিতে জেতার আগেই উদযাপন করে বসেন মুশফিক। শেষ পর্যন্ত হারে বাংলাদেশ। এবার আর সেই ভুল করেননি মুশফিক। দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন। ব্যাঙ্গালুরুর সেই ভূতও যেন তাড়ানো গেল। তামিম এ বিষয়ে বলেছেন, ‘যে ব্যাটসম্যান ব্যাঙ্গালুরুতে ভুল করেছিল, সে সেটি করেনি। ভাল খেলুন কিংবা খারাপ, একজন ব্যাটসম্যানের শেখার অনেক কিছু থাকে। এটা ভাল দিক, খারাপ ম্যাচ থেকে শিখে একটা ম্যাচে আমরা অন্তত কাজে লাগিয়েছি। ওই সময় মুশফিককে যেভাবে সমালোচনা করা হয়েছিল, একইভাবে তাকে প্রশংসা করা উচিত।’ এখন এই জয়কে পুঁজি করে সামনের পথ পাড়ি দিতে হবে।
সামনে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ রয়েছে। এরপর আবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও একটি ম্যাচ রয়েছে। সেই ম্যাচগুলোতে এখন কি করে বাংলাদেশ, এই জয় পেয়ে আসলেই ছন্দে ফিরেছে কিনা; সেইদিকেই সবার নজর থাকছে। তামিম সামনের দিকে তাকাতেই এখন রাজি, ‘সাপোর্টিং স্টাফ বলেন, ম্যানেজমেন্ট, আমরা খেলোয়াড়রা, সবাই চাচ্ছিলাম ভাল করতে। চাচ্ছিলাম একটি ম্যাচ যেন জিতি। সবাই চেষ্টা করছিল, যে করেই হোক একটা ম্যাচ জিততে হবে। গত সিরিজের পর আমরা খুব হতাশ ছিলাম। আমরা মনে করি না যে আমরা এতটা খারাপ দল, যেভাবে খেলছিলাম। এখানেও প্রথম ম্যাচটা ভাল করিনি। দলের জন্য খুব দরকার ছিল জয়টি। এই জয় আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করবে।’ এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে এখন ছন্দে ফেরা বাংলাদেশ সামনেও ভাল কিছু করে দেখাতে পারবে, সেই বিশ্বাসও সবার ভেতর আছে। মুশফিক ম্যাজিকে পাওয়া ছন্দ এখন ধরে রাখা গেলেই হলো।
Check Also
‘পাকিস্তান দলে প্রত্যেক ক্রিকেটারই অধিনায়ক’
টি-টোয়েন্টি সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পেরে ওঠেনি পাকিস্তান। তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচ পণ্ড হয়, …