জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে সাতক্ষীরা *শহরের বাড়ছে বসতি * কর্মহী হচ্ছে লাক্ষ মানুষ *নাগরিক সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে

আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা : জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব,লবণক্ষতা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে উপকুলীয় জেলা সাতক্ষীরা। কাজের সন্ধানে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, আশাশুনি সহ নিন্মাঞ্চল থেকে প্রতি নিয়ত নিন্ম আয়ের মানুষেরা ভীড় জমাচ্ছে সাতক্ষীরা শহরে। ফলে বসবানের অনুপযোগী হচ্ছে শহরের জীবন। শহরের বিল এলাকা গুলোতে হু হু করে বাড়ছে নতুন নতুন বসতি। এসব জনবসতির চাহিদা মেটাতে হিমশীম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় নাগরীকের জীবন যাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
বঙ্গোপসাগরের তীরে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের কোল ঘেঁসে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সাতক্ষীরা।(৩,৪৫৮)তিন হাজার চারশত আটান্ন বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ জেলাতে ২০ লক্ষের অধীক মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৪৯.৪৬% মহিলা ও ৫০.৫৪% পুরুষ। জেলায় মোট ৭টি উপজেলা, ৮টি থানা ৯৬০টি মৌজা ১৬০৩টি গ্রাম ৭৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা রয়েছে। এখানের বার্ষিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৫.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিন্ম ১২.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৭১০ মিলিমিটার। সাতক্ষীরার আদি নাম ছিল বুড়নদ্বীপ। সেখান থেকে সাতঘরিয়া। পূর্ববর্তী সাতঘরিয়া গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা নামকরণ করা হয়। নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায় ১৭৭২ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদিয়ার রাজা কৃষ চন্দ এর একজন কর্মকর্তা বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নিলামে বুড়ন পরগনা কিনে সেখানে সাতঘরিয়া গ্রাম স্থাপন করে বাড়ী নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিষ্ণুরাম চক্রবর্তীর ছেলে প্রাণনাথ রায় চৌধুরী সেটাকে উন্নত করেন এবং আধুনিক সাতঘরিয়ার স্থাপতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৭৮১ সালে বুড়ন থেকে সাতঘরিয়া নামকরণ করা হলেও পরবর্তীতে ১৮৬১ সালে মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলে ইংরেজ রাজ কর্মচারীরা সাতঘরিয়াকে সাতক্ষীরা হিসেবে পরিচিত করান। সেখান থেকেই এ জেলা সাতক্ষীরা হিসাবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। ১৯৪৬ সালের ২১ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
একটি গ্রাম থেকে জেলাটির উৎপত্তি হয়ে বর্তমানে এ জেলাতে ১৬০৩টি গ্রাম নামকরণ হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সিডর ও আইলার মত প্রাকৃতিক দুযোগের কবলে পড়তে হয়েছে জেলা বাসিকে। মিষ্টি পানির পানির অনেক উৎস নষ্ট হয়েগেছে। ভেঙ্গে গেছে বৃহত্তর বেড়িবাঁধ সমূহ। ফলে উপকুলীয় এজেলাতে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। হুমকির মুখে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীব বৈচিত্র। চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। বিলুপ্ত হয়েছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ ও অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি। কর্মসংস্থানের অভাবে এ জেলার হাজার হাজার মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এ জেলার অন্তত্য পাঁচ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে থাকতে হয় বছরের বেশির ভাগ সময়ে। কৃষি জমিতে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষের ফলে কৃষি জমি ব্যাপক আকারে হ্রাস পেয়েছ। ফসলি জমিতে ইটভাটার কারণে কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে। জেলাতে বেশির ভাগ সময়ে কাজ না থাকায় শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তি জেলা সমূহে ভীড় করছে। শিক্ষা,স্বাস্থ্য,খাদ্য সহ নিত্যপর্ণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সংসার চালাতে হিমশীম খাচ্ছে নিন্ম আয়ের মানুষ। সংসারের ঘাণি টানতে পুরুষের পাশা পাশি নারীরাও কাজের সন্ধানে মাঠে নেমে। এক শ্রেণীর,দুর্ণিতিবাজ -সরকারী কর্মকর্তা,পুলিশ সদস্য,রাজনৈতি নেতা,চোরাকারবারী,হুন্ডিব্যবসায়ি সহ কয়েক পেশার কতিপয় লোকজন আঙ্গুল ফলে কলাগাছ হয়েছে। এতে জীবন যাত্রার বৈষম্য বাড়ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে না উঠায় কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে।
সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত জেলাসমূহের মধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা।
বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আগামী ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে দেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ সাগর গর্ভে বিলিন হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা ১০০ সেঃ মিঃ বাড়লে পানির নিচে তলিয়ে যাবে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চল । এতে শরণার্থী হবে সাতক্ষীরার কয়েক লক্ষ মানুষ। শতকরা ২৯ শতাংশ নিচু এলাকা বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। পরিসংখ্যান মতে, গত ৩৩ বছরে বাংলাদেশের কৃষি জমি কমেছে ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর।
এ হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৬৫ হাজার হেক্টর আবাদী জমি কমছে। এই হারে কমতে থাকলে আগামী ২০ বছর পর দেশে কৃষি জমির পরিমাণ দাড়াবে ৫০ হাজার হেক্টরে। এভাবে কমতে থাকলে চরম আকারে সাতক্ষীরা জেলাতে কৃষি জমি হ্রাস পাবে।
ষাটের দশকে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে সাতক্ষীরা জেলাতে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্যে। ঐ সময় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্ধৃত খাদ্য শস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। এক পর্যায়ে ৮০’র দশকে এ অঞ্চলে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংশী লবণ পানির চিংড়ি চাষ। বর্তমানে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা, আশাশুনিজলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয় ও লবণ পানির আগ্রাসনে এ অঞ্চলে চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি জমি। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত জোয়ারের উপচেপড়া পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুর্ন এলাকা। অসংখ্য নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। জেলাতে সুপেয় পানির রয়েছে চরম সংকট। বিচরণ ক্ষেত্র ও গো খাদ্যের অভাবে হ্রাস পেয়েছে গবাদি পশু। গাছ-পালার অভাবে জ্বালানী সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
আবাসস্থল সংকটের কারণে ময়না, টিয়া, ঈগল, দোয়েল, শ্যামা, ঘুঘু সহ অসংখ্য পাখি বণ্য প্রাণী এবং অনেক উভচরপ্রাণী বিলুপ্ত প্রায়।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন জানান, পরিবেশ বিপর্যয় রোধে বর্তমান সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে স্ব-উদ্যোগে একনেকে বড় ধরণের বাজেটের অনুমোদন দেন। জার্মান ভিত্তিক একটি সংস্থা, সাতক্ষীরা পৌরসভায় ১৮০ কোটি টাকার একটি বাজেট দিয়েছে। টাকা ও ছাড় হয়েছে। প্রকল্পনুযায়ী চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কাজ শুরু হবে। এতে সাতক্ষীরা প্রাণ সায়ের খাল প্রাণ ফিরে পেতে কাজ করা হবে। তিনি আরো জানান, জেলাতে আরো ৪শ’ কোটি টাকার কাজ করবে বর্তমান সরকার।
শ্যামনগরে সুপেয় পানি, পানি ধরে রাখা এবং জনসাধরণের কাছে সেই সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কাজ শুরু হতে পারে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরাতে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা অনেকটা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখুনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অদূরভবিষ্যতে উপকূলীয় এ জেলা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।