বেড়েছে চোরের উপদ্রব: জনমনে আতঙ্ক, একমাসে শহরে ১০টি চুরির ঘটনায় একটিরও মামলা হয়নি

আসাদুজ্জামান সরদার: একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানান, তার প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি দু:সাহসিক চুরি সংগঠিত হয়। এ ব্যাপারে তিনি থানায় একটি এজাহার দিলে থানা থেকে বলা হয় মামলা হবে না, জিডি করেন। যথারীতি ঐ প্রতিষ্ঠান প্রধান একই দিন বিকালে একটি জিডি লিখে থানায় পাঠান। এবার থানা থেকে বলা হয়, জিডির নিচে লিখতে হবে তিনি মামলা করতে ইচ্ছুক নন। পরে পুনরায় সেটি লিখে থানায় পাঠালে পুলিশ চুরির ঘটনায় একটি জিডি রেকর্ড করে। এটি শহরের একটি ঘটনা।

গত একমাসে শহরে অন্তত ১০টি চুরিসহ জেলায় কমপক্ষে ৩০টি চুরি সংঘটিত হলেও একটি ঘটনাতেও কোন মামলা হয়নি। সর্বশেষ গত ১১মার্চ অনুষ্ঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থাপিত তথ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে জেলায় একটি চুরিরও মামলা রেকর্ড হয়নি বলে জানা গেছে।

শহরের মর্নিং সান প্রি ক্যাডেট স্কুল, সাতক্ষীরা ছফুরননেছা মহিলা কলেজ, সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়, বে-বার্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল, জিএন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি সরকারি স্কুলে চুরি হয়েছে সম্প্রতি। এছাড়া একাধিক বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল, সোনার গহনা, কম্পিউটার, নগদ টাকা চুরির ঘটনা তো আছেই। এজন্য জনমনে চোর আতঙ্ক বিরাজ করছে।

যদিও চোরের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, বিদ্যুতের তার, ঘটিবাটি, টিউবওয়েল, হাসপাতাল এমনকি মসজিদের দান বাক্সের টাকাও। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ঘটছে চুরির মহোৎসব।

এদিকে, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ি গত কয়েক দিনে সাতক্ষীরা শহরের ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১টি এনজিও অফিসসহ কমপক্ষে ১০টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চুরির আতংক বিরাজ করছে। স্কুল-কলেজ, সরকারি বেসরকারি অফিসের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মডেম, হার্ডডিস্ক ও ইলেট্রিক সামগ্রী চুরি হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ সোমবার দিবাগত রাতে শহরের মুনজিতপুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তরণ অফিসে চুরি সংঘটিত হয়েছে। এরিয়া ম্যানেজার কামাল হোসেন জানান, রবিবার রাত সাড়ে ১০টায় অফিস রুমে তালা দিয়ে উপর তালায় ঘুমাতে যান। সকালে তারা দেখতে পায় অফিসের নিচ তলায় ১ম কক্ষে জানালার গ্রিল কাটা। ঘরে প্রবেশ করে দেখে মনিটর, হার্ডডিস্ক, র‌্যাম, নগদ টাকাসহ মোটা সাড়ে ৩৫ হাজার টাকার জিনিসপত্র চুরি হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ৩ মার্চ ছফুরননেছা মহিলা কলেজে দু:সাহসিক চুরি সংঘটিত হয়েছে। এ সময় চোরেরা কলেজের পিছনের গ্রিল কেটে দুটি ল্যাপটপ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে গেছে। ছফুরননেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুন্নাহার জানান, গভীর রাতে কলেজের পিছনের গ্রিল কেটে অধ্যক্ষের কক্ষ, শিক্ষক কমন রুম ও অফিস কক্ষের আলমারি ভেঙে কাগজপত্র তছনছ করে। এ সময় তারা দুটি ল্যাপটপ চুরি করে নিয়ে যায়। শহরের ইটাগাছা পুলিশ ফাড়ির ইন্সপেক্টর আজিজুর রহমান জানান, সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ রাতে সংঘবদ্ধ চোরের দল শহরের মুন্সিপাড়ার রাশিদা স্কুল এ্যান্ড কলেজে প্রধান শিক্ষকের জানালার গ্রিল কেটে অফিস কক্ষে ঢুকে প্রথমে অফিসের সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে এবং সিসি ক্যামেরার সকল রেকর্ড ডিলেট করে দেয়।
প্রধান শিক্ষক বাপ্পি সার বলেন, দুইটি কম্পিউটার মনিটর, দুইটি ডেক্সটপ, একটি ল্যাপটাপ ও ক্যাশ টেবিলের ড্রয়ার ভেঙ্গে নগদ ১৫ হাজার টাকা এবং আলমারি ভেঙ্গে নগদ ৫০ হাজার টাকাসহ স্কুলের জরুরী কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।
এছাড়া পর্যায়ক্রমে চুরি হয়েছে, মর্নিং সান প্রি-ক্যাডেট স্কুল, নবারুণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বে-বার্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল, জিএন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিবা-নৈশ কলেজ, ফিংড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুনসিপাড়ার জনৈক ইনামুলের বাড়ি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদের বাসভবনে চুরি সংঘটিত হয়। কিন্তু কোন ঘটনাতেই পুলিশ মামলা গ্রহণ করেনি। এমন কি চুরি যাওয়া কোন মালামালও পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি।
সূত্রমতে, মার্চে ১২ তারিখে শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য ও কৃষি অধিদপ্তর অফিস থেকে চুরি হয়। সোমবার ভোর রাত সাড়ে ৩টার দিকে চোরের দল দুটি অফিসে তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে কাগজপত্রাদি তছরুপ করে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে তথ্য নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্তা ব্যক্তিরা। নৈশ প্রহরী, সিসি ক্যামেরা ও চারিদিকে সুরক্ষিত গ্রীল বেষ্টিত থাকার পরেও এ ধরণের চুরির বিষয়টি রহস্যজনক বলে জানিয়েছেন অনেকে। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হোসাইন সাগর ও কৃষি কর্মকর্তা আবুল হোসেন মিয়া জানান, চোরের দল অফিসের ল্যাপটপ ও মোবাইল সেটসহ অন্যান্য মূল্যবান মালামালের কোন ক্ষতি করে নি।
এদিকে চলতি মাসের ৯ তারিখে দেবহাটা-কালিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী বাবুরাবাদ বাজারের ৩ মুদি দোকানে জানালা ও শাটার কেটে চুরি সংঘটিত হয়েছে। মুদি দোকানী ভাই ভাই স্টোরের স্বত্ত্বাধীকারী শরিফুল ইসলাম জানান, তার দোকানের শাটার কেটে ১৫ হাজার টাকা, ৮ কার্টুন সিগারেট, ২টি মোবাইল ফোন এবং দোকানে থাকা ৬০ হাজার টাকার মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে। একই বাজারের আলহেরা স্টোরের স্বত্ত্বাধীকারী আব্দুস সালাম জানান, তার দোকানের শার্টার কেটে নগদ টাকা, কসমেটিক্স সামগ্রী প্রায় ৩০হাজার টাকার মালামাল চুরি হয়ে গেছে। ঢালী স্টোরের স্বত্ত্বাধীকারী আব্দুল আজিজ জানান, তার দোকানের জানালা কেটে ৫ হাজার নগদ টাকা এবং ৬০ হাজার টাকার অধিক মূল্যের মালামাল চুরি হয়েছে।


অপরদিকে, ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখে কালিগঞ্জের কাজলা পোস্ট অফিসে চুরি সংঘঠিত হয়েছে। কাজলা পোস্ট অফিসের ই-সেন্টারের উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার সকালে পোষ্ট অফিসে যেয়ে গ্রিলের লক ও তালা কাটা অবস্থায় আমি দেখতে পাই। এ সময় ভিতরে ঢুকে দেখি অফিসের কাজে ব্যবহৃত দু’টি প্রিন্টার, মোডেম, ল্যাপটপের চার্জারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নেই। এছাড়াও চোর চক্রটি চুরির সময় অফিসের জিনিসপত্র তছনছ করে গেছে। তিনি আরো জানান, পোস্ট মাস্টার বিশেষ কাজে খুলনায় অবস্থান করায় এ ব্যাপারে থানায় জিডি করা সম্ভব হয়নি
সূত্র আরো জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে কলারোয়ায় ৪ নারীর প্রত্যেককে বোরকা চুরির অভিযোগে ২ মাস করে বিনাশ্রম কারাদন্ড করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। দোকান মালিক আবিদুর রহমান জানান, গত রোববার প্রথম দফায় দুপুরে দিকে ওই নারীরা এক সাথে তার দোকানে এসে কাপড়ের বোরকা কিনবে বলে বের করতে বলেন। এগুলো দেখার এক ফাঁকে তারা দোকানে থাকা ১৭ পিস বোরকা চুরি করে নিজেদের পরিধান করা বোরখার মধ্য লুকিয়ে নিয়ে যায়। পরক্ষণে দোকানী বোরকা না পেয়ে সিসি ক্যামারায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দেখে চিনে রাখে তাদের। দ্বিতীয় দফায় দোকানী কাপড় পেড়ে দিয়ে ওঁৎ পেতে থাকেন এবং ২১ পিস কাপড় চুরি করে পালানোর সময় তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন। এমনিভাবে প্রায় প্রতিদিন জেলার কোনো না কোনো এলাকায় ঘটছে চুরির ঘটনা। এতে জেলার মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে।
সদরের ধুলিহর এলাকার আলতাফ হোসেন দৈনিক পত্রদূতকে বলেন, এলাকায় প্রতিদিন চুরি হচ্ছে কিন্তু কোন চোর ধরা পড়ছে না। এখন সাতক্ষীরা জেলা যেন চোরের জনপদে পরিণত হয়েছে।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার দেব নাথ দৈনিক পত্রদূতকে জানান, আমার থানায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত তিন মাসে আমার থানায় কোন চুরির ঘটনা ঘটেনি এবং থানায় কোন অভিযোগ আসেনি।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুবীর দত্ত দৈনিক পত্রদূতকে জানান, গত তিন মাসে কালিগঞ্জ থানায় তিনটি চুরির মামলা হয়েছে এবং এ ঘটনায় ৭জনকে আটক করা হয়েছে। তবে তারা পেশাদার চোর নয়, নেশাখোর। চুরি যাওয়া মালামালও উদ্ধার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখে কালিগঞ্জের কাজলা পোস্ট অফিসে চুরির ঘটনা সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।
তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান দৈনিক পত্রদূতকে জানান, গত তিন মাসে আমার থাকায় কোন চুরির অভিযোগ আসেনি।
আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহা. মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক পত্রদূতকে জানান, আমি তিনদিন আগে যোগদান করেছি। তবে আমার থানায় কোন চুরির অভিযোগ নেই।
দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী কামাল হোসেন দৈনিক পত্রদূতকে জানান, গত তিন মাসে আমার থানায় কোন চুরির মামলা হয়নি। বাবুরাবাদ বাজারের ৩ মুদি দোকানে জানালা ও শার্টার কেটে চুরির ঘটনা তিনি জানেন না বলে জানান।

dav

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মান্নান আলী দৈনিক পত্রদূতকে জানান, গত তিন মাসে আমার থানায় কোন চুরির মামলা হয়নি। সম্প্রতি দুটি সরকারি অফিসে চুরির ঘটনায় কোন মামলা করেনি। তবে বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। চোর ধরতে পুলিশী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মারুফ আহম্মেদ দৈনিক পত্রদূতকে জানান, বিভিন্নস্থানে বিদ্যুৎ না থাকার কারনে চুরি হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নৈশ প্রহরীরা ঠিকমত দায়িত্ব পালন না করায় চুরি হচ্ছে। এই চুরি রোধ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের- আমাদের না। ৩ মার্চ ছফুরননেছা মহিলা কলেজে চুরির ঘটনায় একটি জিডি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন চুরির ঘটনায় মামলা হয় না।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক দৈনিক পত্রদূতকে জানান, জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে জেলা পুলিশ সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় চুরির ঘটনায় মামলার নেওয়ার জন্য আমাদের তদন্ত চলছে। চুরি রোধ করতে এবং চোরদের ধরতে আমরা কাজ করছি।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।