ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: কানাডা: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বাংলাদেশের একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। চলমান সংসদ ভেঙ্গে দিতে কিংবা আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে ডাকা ‘হরতাল’ কর্মসূচি সন্ত্রাস নয়। বিএনপিকে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার পূর্বের অনুসন্ধান ও তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বিচারকের রায় কোনো ভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন অভিমত ব্যক্ত করেছে কানাডার সর্বোচ্চ আদালত।
সম্প্রতি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য এক বাংলাদেশির করা আবেদনের প্রেক্ষিতে রায়ে স্পষ্ট করে এমনটাই বলেছেন দেশটির ফেডারেল কোর্টের বিচারক রিচার্ড জে মোসলে। গত ১ মার্চ কানাডার ফেডারেল কোর্টের দেয়া রায়ে দেশটিতে আশ্রয় সংক্রান্ত আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
বাংলাদেশে প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলের ওপর সরকারের গ্রেফতার, দমননীতির অব্যাহত অবনতিকর পরিস্থিতির দিক তুলে ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন করেন মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী নামের এক বাংলাদেশি।
সেই সময় কানাডার অভিবাসন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তার আবেদন নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পরিচালনা করে বলে মত দেন। তার এ অভিমতকে একতরফাভাবে ‘বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল ঘোষণা দিয়েছে কানাডা’ বলে প্রচারণা চালায় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার। এ নিয়ে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম খবরও প্রকাশ করে।
সংক্ষুব্ধ এক ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কানাডার উচ্চ আদালতে গেলে বিএনপির বিরুদ্ধে করা ট্রাইব্যুনাল বিচারকের মন্তব্য অবান্তর বলে মত দেন দেশটির ফেডারেল কোর্টের বিচারক রিচার্ড জে মোসলে ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত কি না তা বুঝতে তদন্তকারী অভিবাসন কর্মকর্তা ইন্টারনেটে কিছু অনুসন্ধান চালান। এতে বলা হয়, অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি ছিলো ত্রুটিপূর্ণ।
সংবাদ সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি সংগঠন ও অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি একটি ধারণা নেন। যাতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে থাকে। এতে বলা হয়, তদন্ত কর্মকর্তা যে বিষয়টিতে নজর দিয়েছে বিশেষ করে তা হলো ধর্মঘট। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি হরতাল নামে পরিচিত। জনমানুষ সম্পৃক্ত, জনগণের প্রতিবাদ হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এ কর্মসূচির গোড়াপত্তন করেন নেতা মহাত্মা গান্ধী। তদন্ত কর্মকর্তা তার অনুসন্ধানে যেটা পেয়েছেন সেটা হলো- বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যে দলই ক্ষমতার বাইরে থাকে তারা চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে হরতাল ব্যবহার করে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে আর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে সরকারের বিরুদ্ধে এ কর্মসূচির আহ্বান করা হয়।
হরতাল আ্বান করা সন্ত্রাসবাদের আওতায় পড়ে না উল্লেখ করে বিচারক রিচার্ড জে মোসলে তাঁর রায়ে বলেন, ‘চলমান সংসদ ভেঙে দিতে কিংবা আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে কোনো রাজনৈতিক দল আহুত ‘হরতাল’ কর্মসূচি কোনোভাবেই সন্ত্রাসবাদের আওতায় পড়ে না।
বিএনপি নিয়ে অভিবাসন কর্মকর্তার সন্ত্রাসে জড়িত থাকার যে অভিযোগ তার সঙ্গে পুরো দ্বিমত পোষণ করে বিচারক বলেন, বিএনপি’র হরতাল আহ্বান করার সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাও সন্ত্রাসের সম্পৃক্ততা খোঁজার সঙ্গে আমি কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকতা এটাও জেনেছেন যে, বিএনপি নেতারা সহিংস কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে বিচারক বলেন, অনুসন্ধানে কিছুতেই এটার প্রমাণ নেই যে, যার কারণে বলা যায় ‘হরতাল’ ডাকা মানে সন্ত্রাসের সমর্থক।
বিচারক তার মন্তব্যে বলেন, কানাডার কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কেবল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের কারণে এমন মন্তব্য করা হলে তা হতো কানাডার চাটার্ড অব রাইটের মারাত্মক লঙ্ঘন।
ইমেগ্রেশন ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের কড়া সমালোচনা করে বাতিল করেন সর্বোচ্চ এই আদালত। বিচারক রিচার্ড জে মোসলে বলেন, ‘আমি আগের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নই। এটা ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং আইনসঙ্গত রায় বলে প্রতিয়মান নয়।’
এই রায়ের এক প্রতিক্রিয়ায় কানাডা বিএনপি নেতা ক্যাপ্টেন (অবঃ)মারুফ রাজু বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে কানাডার সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রশংসা করেছেন। আগের দেয়া একটি ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারকের দেয়া মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের দোসররা বিএনপিকে বহির্বিশ্বে হেয় প্রতিপন্ন করার মিশনে নেমেছিলো। কিন্তু ফেডারেল কোর্টের এই ‘ঐতিহাসিক’ রায়ের মাধ্যমে তাদের সে মিশন ভেস্তে গেছে।
আগের রায়টি ক্ষমতাসীনরা পড়েও দেখেনি মন্তব্য করে কানাডা বিএনপি নেতা এজাজ আকতার তৌফিক বলেন, সেখানে আওয়ামী লীগেকেও সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হয়েছিলো। অথচ তারা নানা প্রলেপ লাগিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলর প্রতারণা চালিয়েছে।
কানাডা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কানাডা বিএনপি নেতা আনসারউদ্দীন আহমদ বলেন, কানাডা সরকার ও শীর্ষ রাজনীতিকরা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন ইমেগ্রেশন কোর্টের একজন বিচারকের মন্তব্যের সাথে কানাডার সরকার ও রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই রায়ে তারও প্রতিফলন হয়েছে। এখন পূর্বের বিতর্কের অবসান হলো বলেও মনে করেন তিনি।
কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ের কপির লিঙ্ক