গত ২৬ অক্টোবর শেরপুর উপজেলার গাজীর খামার ইউনিয়নের চককোমড়ি গ্রামে কণিকা নামের ১২ বছরের এক কিশোরী ক্ষুধার জ্বালায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরিবারটির এত অভাব-অনটন যে, লাশ কবর দেয়ার খরচটিও এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে দিয়েছে। কণিকার বাবা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিবারে অভাব কাটছিল না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ও ধনবান, অর্থবিত্তের মালিক- কেউই জানত না কণিকাদের অভাব-অনটনের খবর, কেউই এগিয়ে আসেনি এই অসহায় পরিবারটিকে সাহায্য করার জন্য। দেশের এত উন্নতি-অগ্রগতির পরও অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে ক্ষুধার জ্বালায় ১২ বছরের এক কিশোরীকে আত্মহত্যা করতে হল। কী হবে আমাদের এই তথাকথিত উন্নতি-অগ্রগতি দিয়ে, যদি বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম খাবার-দাবার দিয়ে কণিকাদের মতো ক্ষুধাপীড়িত ছোট ছেলেমেয়েদের আমরা বাঁচাতে না পারি।
দেশে কণিকাদের আত্মহত্যার খবর নতুন নয়। বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে দীপালি নামের এক কিশোরীর আত্মহত্যার খবর পড়ে আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। প্রায় এক সপ্তাহ আমি এই শোকে ভুগেছি, যেমন ভুগেছি কণিকার মৃত্যুতে। আরও একটি মর্মান্তিক খবর পড়ে মর্মাহত হয়েছিলাম। ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত স্বজনহারা একান্ত একা এক বুড়ো লোককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ক্ষুধা পেলে আপনি কি করেন? বৃদ্ধ অসহায় লোকটি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এই জগতে ভগবান ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। তাই ক্ষুধা পেলে ভগবানকে ডাকি।’ বিশ্বনন্দিত চিত্রসাংবাদিক কেভিন কার্টারের তোলা হৃদয়বিদারক একটি ছবি আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে এই ছবির জন্য কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার পান। ছবিটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে সুদানে দুর্ভিক্ষপীড়িত এক ক্ষুদে মৃতপ্রায় শিশু ১ কিলোমিটার দূরে জাতিসংঘের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের দিকে গুটিসুটি মেরে এগোতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। হামাগুড়ি দিয়ে সামান্য এগিয়েই মাটিতে মাথা রেখে আবার দম নেয়ার জন্য থেমে যাচ্ছে। পেছনে সামান্য দূরত্বে একটি শকুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিশুটির দিকে। শকুনটির অপেক্ষা- শিশুটি মারা গেলে তাকে সে খাবে। দৃশ্যটি সহ্য করতে না পেরে কেভিন কার্টার ছবিটি তুলে স্থান ত্যাগ করে চলে যান। পরে শিশুটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায়নি। তবে এটা জানা যায়, তিন মাস পর প্রচণ্ড মানসিক বিষণ্ণতার কারণে কেভিন কার্টার আত্মহত্যা করেন।
আজ আরও একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ছবির কথা মনে পড়ছে। জরাজীর্ণ একটি জামা পরা অযত্ন-অবহেলায় গড়ে ওঠা একটি নিরীহ অসহায় অবোধ শিশু রাস্তা থেকে খাবার নামের পরিত্যক্ত বর্জ্য কুড়িয়ে খাচ্ছে। কেউ হয়তো খাওয়ার পর কিছু অংশ বর্জ্য হিসেবে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে গেছে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য অসহায় শিশুটি তাই নীরবে খেয়ে চলেছে।
এই ছুড়ে ফেলা বর্জ্যই তার জন্য বেঁচে থাকার অবলম্বন। কারণ সে বঞ্চিত, সে লাঞ্ছিত, ক্ষুধায় তার দিন কাটে। পেলে খায়- হোক তা ঝুটা বা বর্জ্য, না পেলে উপোস করে। তার চেহারা এবং অবস্থা দেখে মনে হয়, এই সমৃদ্ধ ও সভ্য সমাজের বাসিন্দা হওয়ার পরও তার কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। প্রিয় পাঠক, বিশ্বের অন্যান্য দরিদ্র দেশের মতো এই ধরনের দৃশ্য আমাদের দেশেও হরহামেশা চোখে পড়ে। রাস্তা বা ডাস্টবিন থেকে ঝুটা বর্জ্য খাচ্ছে এই শিশুটির মতো আরও অসংখ্য শিশু। আমরা এসব দেখি কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দিই না। আমরা নিয়তির ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাসী বলে এসব মর্মান্তিক দৃশ্য বা ঘটনাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিই। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
কেন এত অল্প বয়সের একটি অবুঝ শিশু রাস্তা বা ডাস্টবিন থেকে খাবার নামের আবর্জনা বা বর্জ্য কুড়িয়ে খাবে? এই বয়সী একটি শিশুর থাকার কথা তার বাবা-মায়ের কোলে। বাবা-মায়ের আদর-যত্ন, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসায় তার কচিমনটি ভরে ওঠার কথা। সেজেগুজে টিফিনবক্স ব্যাগে পুরে স্কুলে যাওয়ার কথা।
তার বাড়ন্ত শরীরের প্রয়োজনে নামিদামি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা। এরা এসব সুযোগ-সুবিধা, আদর-যত্ন থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এরা খেয়ে না খেয়ে, ক্ষুধার জ্বালায় পরিত্যক্ত ঝুটা-ঝাটি খেয়ে হয়তো কোনোরকমে বেঁচে যাচ্ছে, না হয় নীরবে-নিভৃতে মরে যাচ্ছে। ছবিতে শিশুটির যে অসহায়ত্বের ভাব ফুটে উঠেছে এবং সে যা খাচ্ছে, তা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এ নিয়তির খেলাও নয়। এ অন্যায়, এ প্রবঞ্চনা। আমরা সমাজের শিক্ষিত, সভ্য ও ধনবান মানুষ। আমরা এদের ঠকাচ্ছি, এদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি।
প্রতি বছর ১ কোটি ৫০ লাখ শিশু মারা যায় ক্ষুধার্ত অবস্থায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্ষুধার্ত। প্রতি ৩.৬ সেকেন্ডে কোনো একজন মারা যায় ক্ষুধার তাড়নায়। আমাদের উপমহাদেশ এবং আফ্রিকায় বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুধার্ত মানুষের বসবাস। ’৯০-এর দশকে ১০ কোটির বেশি শিশু ক্ষুধার কারণে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই লেখাটি পড়ে শেষ করতে যতটুকু সময় লাগবে, তাতে কম করে হলেও ২০০ মানুষ ক্ষুধায় মারা যাবে এবং বছরান্তে এই সংখ্যাটি দাঁড়াবে ৪০ লাখে। পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, অপুষ্টিতে আক্রান্ত এসব মানুষের ৮০ শতাংশ শিশু ও মহিলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর প্রায় ৫০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়স্ক প্রায় ৮৫ লাখ শিশু নামমাত্র বেঁচে থাকলেও উপবাসের কারণে এরা কোনো না কোনো সময় মৃত্যুবরণের জন্য দিন গোনে।
ইউনাইটেড ন্যাশন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (টঘঊচ) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রণীত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জরিপ মোতাবেক বিশ্বে প্রতি বছর উৎপাদিত ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাবার অপচয় হয় বা নষ্ট করে ফেলা হয়। এই অব্যবহৃত বা অপচয়কৃত খাবারের ৪৫ শতাংশ হল শাকসবজি ও ফলমূল, ৩৫ শতাংশ মাছ ও সামুদ্রিক খাবার, ৩০ শতাংশ খাদ্যশস্য, ২০ শতাংশ দুগ্ধজাত খাবার এবং ২০ শতাংশ মাংস। এই অপচয়ের মূল কারণ লুকিয়ে আছে খাদ্য উৎপাদনে বা খাদ্যের ব্যবহার পদ্ধতিতে। টাকার অঙ্কে এই অপচয়ের পরিমাণ প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (এক হাজার বিলিয়ন ডলার)। ক্যালরির হিসাবে প্রতি চার ক্যালরির এক ক্যালরির সমপরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়। আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুধা ও অপুষ্টি এক চিরন্তন সত্য, খরা, যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মাইগ্রেশন বা অভিবাসন, খাদ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্য, সামাজিক অস্থিরতা, বঞ্চনা, বৈষম্যমূলক বণ্টন ব্যবস্থার কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে এবং মৃত্যুবরণ করছে, সেই নেতিবাচক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের এই অসহনীয় অপচয় মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনকই শুধু নয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও এক জঘন্য মানবিক অপরাধ।
প্রতি বছর শুধু কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশে যে পরিমাণ খাদ্যের অপচয় হয়, তা সাবসাহারা অঞ্চলে উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় সমান, অংকের হিসাবে যা ২৩০ মিলিয়ন টন। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০-৪০ শতাংশ খাদ্যের অপচয় হয়, যা গড়ে প্রতি মাসে প্রতিজনের ২০ পাউন্ড খাবারের সমান। আমেরিকানরা প্রতি বছর ১৬৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাবার ফেলে দেয় বা ধ্বংস করে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ফলমূল ও শাকসবজি বাজারে না পাঠিয়ে খেতেই নষ্ট করে ফেলা হয়। দেখতে নিখুঁত, আকর্ষণীয় ও কসমেটিক মানের না হওয়ার কারণে ক্রেতারা এ সব শাকসবজি ও ফলমূল কিনতে চায় না বলে কৃষকরা এসব ফলমূল ও শাকসবজি জমিন থেকে তোলে না। যুক্তরাজ্যে ২০০৯ সালে যে পরিমাণ শস্য ও রুটি ফেলে দেয়া হয়েছে, তা দিয়ে বিশ্বের ৩ কোটি মানুষের অপুষ্টি দূর করা যেত।
বিশ্বে প্রতিদিন প্রতিজনের জন্য ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির সমপরিমাণ ফসল ফলানো হয়। কিন্তু গড়ে তার অর্ধেকেরও কম ব্যবহৃত বা খাওয়া হয়, বাকি অংশ অপচয় হয়। উত্তর আটলান্টিক ও উত্তর সাগরে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন (২৩ লাখ) টন ধৃত মাছ ফেলে দেয়া হয়। ইউরোপে যত মাছ ধরা হয়, তার ৪০-৬০ শতাংশ ফেলে দেয়া হয় এই কারণে যে, সেগুলো সঠিক আকার-আকৃতির হয় না, ভিন্ন প্রজাতির হয়, নতুবা কোনো না কোনোভাবে ত্রুটিযুক্ত হয় যা বাজারে পাঠানো হয় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মোতাবেক, বিশ্বে যে পরিমাণ খাবারের অপচয় হয়, তা দিয়ে ৩০০ কোটি অভুক্ত মানুষের খাবারের সংস্থান করার পরও উদ্বৃত্ত খাবার দিয়ে বিশ্বের দরিদ্র দেশের মানুষের ১৩০ শতাংশ পুষ্টিচাহিদা পূরণ করা যেত।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অন্য এক হিসাব মতে, বিশ্বের উৎপাদনশীল জমিতে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার পরিত্যক্ত হয়, তাতে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয়, নষ্ট হয় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন হেক্টর জমি, যা বিশ্বের ফসল উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণের প্রায় ২৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্বে উৎপন্ন মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১০ শতাংশ উৎপন্ন হয় এমন সব খাবারের উৎপাদন, সরবরাহ ও সংরক্ষণের জন্য, যা আদৌ খাওয়া হয় না।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট লোকসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯৬০ কোটি। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আসবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার অর্ধেক আসবে শুধু আফ্রিকা থেকে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা ভেবে কূল পাচ্ছেন না, এসব মানুষের খাবারের সংস্থান হবে কিভাবে! জাতিসংঘের মতে, এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের দরকার হবে না। বিশ্বব্যাপী খাবারের যে অপচয় হয়, তা রোধ করা গেলে এবং সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা গেলে বিশ্বের কাউকেই না খেয়ে থাকতে হবে না।
আগেই বলেছি, খাবারের অসহনীয় অপচয়ের বেশির ভাগ হয়ে থাকে উন্নত বিশ্বে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় প্রতিটি মানুষ প্রতি বছর ৯৫-১১৫ কেজি খাবার অপচয় করে। সাবসাহারা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বছর প্রতিজনের এই অপচয়ের পরিমাণ ৬-১১ কেজি। অনুন্নত দেশগুলোতে ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ উৎপাদন পদ্ধতি, অবকাঠামোগত অব্যবস্থা, সেকেলে যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার জন্য খাবারের অনেক অপচয় হয়। অনুন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটালেও সম্পদশালী সম্প্রদায়ের খাবার অপচয় উন্নত দেশের মানুষের চেয়ে নেহাত কম নয়।
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে বলে দাবি করা হয়। তারপরও দেশের লাখো মানুষ প্রতিনিয়তই অনাহার-অর্ধাহারে কাটায়। বাংলাদেশে খাবারের অপচয় নেহাত কম নয়। বিভিন্ন পার্টি, সামাজিক অনুষ্ঠান ও বিয়ে-শাদি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ধনবানদের হাজার হাজার লোকের মেজবান খাওয়ানোর আয়োজনে গেলে অপচয়ের মাত্রাটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক অপচয় করি, সকালের নাশতা, দুপুরে বা রাতের খাবার টেবিলে আমরা কত খাবার নষ্ট করি।
বিয়ে-শাদি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে খাবার-দাবারে যে হারে অপচয় হয়, তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত। ওপরের ঘটনাগুলো স্মরণ করলে সবার উপলব্ধি হওয়ার কথা, ক্ষুধা কী জিনিস। একশ্রেণীর মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে, লাখো-কোটি টাকা ও খাবার-দাবারের রাজসিক অপচয়ের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় দিন কাটাচ্ছে। আর একই সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে কণিকা-দীপালিরা আত্মহত্যা করছে- এ কোন সমাজ? আমরা যে হারে খাবার-দাবার অপচয় করি, তা রোধ করা গেলে হাজার হাজার জীবন রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহ যেন আমাদের এসব বোঝার শক্তি ও ক্ষমতা প্রদান করেন। আমরা সবাই যেন ভাবি, খাবার ভালো হোক বা মনঃপূত না হোক, আমরা কোনো অবস্থাতেই খাবার অপচয় করব না।
কণিকা-দীপালিদের ক্ষুধার যন্ত্রণা ও আত্মহত্যা যেন আমাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করে। আমাদের মানবতাবোধকে জাগিয়ে তোলে। প্রিয় পাঠক, আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের অন্ধ স্বার্থ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে নিজকে গড়ে তুলি, প্রয়োজনে যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই, তাহলে কণিকা, দীপালি বা সুদানের ক্ষুধাপীড়িত শিশুটির এই মর্মান্তিক ঘটনা হয়তো আমাদের আর দেখতে বা পড়তে হবে না। আমরা খেতে বসলে বেশির ভাগ খাবারই ঝুটা হিসেবে বর্জন করে উঠে যাই। এই ঝুটার জন্য হয়তো অপেক্ষা করে থাকে অনাহার-অর্ধাহারে থাকা অসংখ্য অসহায় বঞ্চিত মানুষ। এসব ঝুটা খাবার ডাস্টবিনে ফেলা হলে তার জন্য এসব ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ের মধ্যে কাড়াকাড়ি, মারামারি হতে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এসব করুণ দৃশ্য আমাদের নজর কাড়ে বটে, কিন্তু বিবেককে নাড়া দেয় না।
অপচয় রোধের কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। এটা সম্পূর্ণ সহমর্মিতা ও উপলব্ধির ব্যাপার। হয়তো তা ব্যক্তিগত নতুবা সমষ্টিগত। তবে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অপচয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবিক গুণাবলির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া জীবনযাপন সম্ভবপর নয়। বিবেকের তাড়নায় মানুষ সব রকম অপচয় রোধে সদা সজাগ থাকবে। যে কোনো ধরনের অপচয় বা অপব্যবহার শুধু অনৈতিক নয়, অমার্জনীয় অপরাধও বটে। অপচয়ের সঙ্গে এক ধরনের স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা জড়িত আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় বড় ধরনের গুনাহর কাজ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপচয় করো না। নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা আল্লাহর কালাম পড়ি কিন্তু তা পালন করি না। এ যে কত বড় পাপ, তা যদি আমরা বুঝতাম!
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়