সন্দেহজনক লেনদেন, অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির শীর্ষ ৯ নেতাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে একযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দলটির যেসব নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলামখান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ও তার ছেলে তাবিথ আউয়াল, এম মোর্শেদ খান ও তার ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খান, হাবিবুন্নবী খান সোহেল।
অনুসন্ধানের এই তালিকায় ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের নামও রয়েছে। বিএনপির এই নেতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে কমিশন থেকে সোমবার দুদকের উপপরিচালক মো. সামসুল আলমকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়।
দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা আজকালের মধ্যেই দুদকের ওই কর্মকর্তা বিএনপি নেতাদের ব্যাংক হিসাবে গত এক বছরের লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেবেন বলে দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া ও সবকটি তফসিলি ব্যাংকেও চিঠি দেবেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য আসার পর অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির ওই নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক।
সূত্র জানায়, বিএনপির ওই নেতাদের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন লেনদেন, অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়ার পর তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন রোববার যুগান্তরকে বলেন, কার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের নাম আমি বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি অন্যদের বিষয়ে অনুসন্ধান তদন্ত যেভাবে হয় তাদের (বিএনপি নেতা) বিষয়েও একইভাবে অনুসন্ধান কাজ চলবে। এতে অতিরিক্ত কোনো গুরুত্ব দেয়া বা কেউ নেতা কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে দুদক সরকারের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। আমরা সেটাই করছি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিএনপির এই কয়েক নেতাসহ আরও কিছু উচ্চপর্যায়ের নেতা এইচএসবিসি ব্যাংক, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিগত দশকে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। বিভিন্ন নাশকতার কাজে অর্থলেনদেন করেছেন।
এতে বলা হয়, বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার ব্যাংক হিসাব থেকে গত ৩০ দিনে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। নাশকতা সৃষ্টির জন্যই এই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে ওই রিপোর্টে বলা হয়।
দুদকের কাছে রক্ষিত গোয়েন্দা অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, আবদুল আউয়াল মিন্টুর এইচএসবিসি ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনটি চেকের মাধ্যমে ১১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। তিনটিই ক্যাশ চেক। এর মধ্যে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার দুটি চেক ঢাকায় নগদায়ন করা হলেও তৃতীয় চেকের অর্থ উত্তোলন কর হয় চট্টগ্রাম থেকে।
১৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল আউয়াল মিন্টুর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে নগদে উত্তোলন করা হয় ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর একটি চেক নগদায়ন করা হয় কুমিল্লা থেকে। ২০ ফেব্রুয়ারি আবদুল আউয়াল মিন্টু ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি চেক নগদায়ন করা হয় খুলনা থেকে।
আবদুল আউয়াল মিন্টুর ২৫ ফেব্রুয়ারি এইচএসবিসি ব্যাংকের হিসাব থেকে আরও দুটি চেকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
অভিযোগে বলা হয়, ১২ ফেব্রুয়ারি আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে ১৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি তার ন্যাশনাল ব্যাংকের হিসাব থেকে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২২ ফেব্রুয়ারি ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয় ব্যাংকটির নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে।
অন্যদিকে বিএনপি নেতা মোর্শেদ খান আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চারটি চেকের মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে চারটি চেকের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে। মোর্শেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খানের স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চারটি চেকের মাধ্যমে তোলা হয় ৯ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফয়সাল মোর্শেদ খান বর্তমানে দেশের বাইরে থাকার পরও কীভাবে এত বিপুল টাকা নগদায়ন করা হলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এছাড়া ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ডাচ বাংলা ব্যাংকের হিসাব থেকে গত ৩ মার্চ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে ১২টি চেকের মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি চেকের অর্থ উত্তোলন করা হয় ঢাকার বাইরে থেকে। মির্জা আব্বাসের ঢাকা ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৪ মার্চ আরও ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদায়ন করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুবর রহমানের আঁতাত রয়েছে। বিভিন্ন অবৈধ লেনদেন ও মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মির্জা আব্বাসের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান নিজেও শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম খান ও হাবিবুন্নবী খান সোহেলের বিষয়ে এতে বলা হয়, তারা তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে গত ২ সপ্তাহে ৭ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। তবে কোন ব্যাংক থেকে এই দুই নেতা অর্থ উত্তোলন করেন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার উল্লেখ নেই বলে দুদক সূত্র জানায়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৪-১৫ সালে দেশে নাশকতা ও অরাজকতা সৃষ্টির আগে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক ও নগদ লেনদেনের ঠিক একই রকম তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ঠিকই বিএনপি নেতারা দেশে জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এতে বলা হয়, বিএনপি নেতাদের এসব অবৈধ লেনদেনে ও টাকা পাচারে সহায়তা করছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএনপি নেতারা অবৈধভাবে টাকা পাচার করে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমসহ বিদেশে অনেক ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট করেছেন। সরকারি ব্যাংকে লেনদেন করলে ধরা পড়ে যাবেন এই ভয়ে তারা অবৈধ লেনদেনের জন্য বেসরকারি ওই ব্যাংকগুলোকে বেছে নিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামেও দেশে বিদেশে একাধিক বাড়ি গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসায় শেয়ার রয়েছে।