সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারি ওদুদ এখন কোটিপতি

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরায় এক স্কুলশিক্ষককে বদলি নিয়ে তৈরি হয়ে ধু¤্রজাল। ওই বদলির ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিক্ষাক জান্নাতুল ফেরদৌসের অপকর্ম ঢাকতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ জাকির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ একরামুল কবীর যোগ দিয়েছেন অপকর্মের সহযোদ্ধা হিসেবে। অন্যদিকে সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারি আবদুল ওদুদ শিক্ষকদের বদলি বাণিজ্য করে এখন কোটিপতি বনে গেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই তার স্কুলশিক্ষক ছেলে সালাউদ্দীনকে অসুস্থতাজনিত কারণে বদলি চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইয়ের ছেলে। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে শিক্ষক সালাহউদ্দীন আল মনিফ সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হলে তাকে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। এক পর্যায়ে তার হাঁটুতে অপারেশন করে নাট-বল্টু লাগিয়ে দিয়ে চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু তার হাঁটুতে নাট-বল্টু লাগানোর ফলে বর্তমানে তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এবং দুই বছর পর আগামী আগস্ট মাসে তাকে আবারও অপারেশনের টেবিলে যেতে হবে। কারণ সে সময় তার হাঁটুতে লাগানো নাট-বল্টুসহ অন্যান্য জিনিসপত্র অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করা হবে। শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফ শারীরিক এই সীমাবদ্ধতার কারণে চলাফেরায় কষ্ট হওয়ায় তাকে শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে তার বাড়ির পাশে নবনুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার মায়ের অবসরজনিত শূন্যপদে বদলির জন্য আবেদন করেন ২০১৬ সালে। এই আবেদন করার দেড় বছর পার হলেও তার বদলি করার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ওই সময়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারি আবদুল ওদুদ শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফ বদলির ওই আবেদনপত্র উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে উপস্থাপন না করে চেপে রাখেন উৎকোচ গ্রহণের জন্য। এক পর্যায়ে সালাহউদ্দীন আল মনিফ বাবা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে তার ছেলের বদলির আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে এবং কাগজপত্র দেখালে আবদুল ওদুদ ওই ফাইল থেকে আবদুল হাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছুড়ে ফেলে দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নানারকম কটুক্তি করেন। আবদুল হাই এর প্রতিবাদ করলে ওদুদ তার উপর চড়াও হন। ওই সময় এক পর্যায়ে সেখানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবুবক্কর সিদ্দিক উপস্থিত হলে বিষয়টির সুরাহা হয়।
উল্লেখ্য, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারি আবদুল ওদুদ সামান্য অফিস সহকারি হয়েও এখন কোটিপতি। অতিসম্প্রতি আবদুল ওদুদ শহরের কামালনগরে ৩০ লক্ষাধিক টাকা দিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। তার টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া তার গ্রামের বাড়িতেও তিনি অঢেল সম্প্রতি করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে তার একটি বড় সিন্ডিকেট।
এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবুবক্কর সিদ্দিকের সাথে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইদিন শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফের পিতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসে ছেলের বদলির বিষয়ে জানতে গেলে ওই অফিসের অফিস সহকারি আবদুল ওদুদ তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছুড়ে ফেলে দেন। পরে আমরা জানতে পেরে সেখানে গেলে বিষয়টি সত্য বলে আমরা জানতে পারি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কটুক্তিকারী আবদুল ওদুদের শাস্তি চাই।
এদিকে, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির সময় প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত হওয়ায় শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফ বদলির জন্য সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর বদলির আবেদন করেন। আবেদনে শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এবং সংশ্লিষ্ট উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশকৃত জমা দেন সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর। ওই আবেদন করার পর স্থানীয় সাতক্ষীরা সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি মিসেস রিফাত আমিনের ডিও লেটারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও আবেদন করেন শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফ। ওই আবেদনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িতদ্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সালাউদ্দীন আল মনিফকে তার মায়ের অবসরজনিত শূন্যপদে নবনুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করার জন্য স্কুলের নাম নির্দিষ্ট করে দিয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরবার নির্দেশ প্রদান করেন। মন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌসকে স্মারক নম্বর উল্লেখ করে মন্ত্রীর সুপারিশসহ চিঠি দেন মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফকে বদলির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চিঠি দেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সালাহউদ্দীন আল মনিফের বদলির বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এবং এ সংক্রান্ত কোন তথ্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানাননি। এক পর্যায়ে শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফের বাবা অসুস্থ ছেলের বদলির বিষয়ে জানতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে তাকে বলা হয় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কোন কিছুই তাকে জানাননি এবং কোন চিঠিও দেননি।
এ বিষয়ে শিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফের পিতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইয়ের কাছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ছেলের বদলির ব্যাপারে এই দীর্ঘ সময়ে কোন প্রতিকার না পেয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সাতক্ষীরা জেলা শাখার কর্মকর্তাদের কাছে কোন সহযোগিতা না পেয়ে তিনি গত ২৯/০৩/২০১৮ তারিখে ঢাকায় যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হকের নিকট থেকে সুপারিশ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন জমা দিয়েছেন।
এ ছাড়া তিনি তার ছেলে স্কুলশিক্ষক মোঃ সালাহউদ্দীন আল মনিফকে নবনুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকটও আবেদন করেছেন।
এদিকে, সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সম্প্রতি তার দুর্নীতি ও অনিয়মের ফিরিস্তি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ জাকির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ একরামুল কবীর স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিবাদ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌসের নিকট তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তার পক্ষে কেন শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির নেতারা আমার সহকর্মী, তারা আমাকে ভালবাসে তাই বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
এদিকে, শিক্ষা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌসের দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কটুক্তিকারী সাতক্ষীরা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারি আবদুল ওদুদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সহযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের জাহির করতে এবং দুর্নীতি ঢাকতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ জাকির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ একরামুল কবীর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সৎ ও ভালো অফিসার সেজন্য তার পক্ষে আমরা বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি দিয়েছি।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
০২.০৪.২০১৮

Check Also

‌‘আ.লীগ-বিএনপি বা যে কোনো রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জামায়াতের নেই’

বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।