কাশ্মীর। দুনিয়ার বেহেশত। নাম শুনলেই সবুজ প্রকৃতির দিকে মন চলে যায়। হৃদয়ে হিল্লোল তুলে মুগ্ধ করা আবেশের। প্রাণে প্রাণে বাজে প্রেরণার সুর। আহ্, কি সুন্দর করে সাজিয়েছেন এ প্রকৃতি। এ ধরা। এ জায়গা। যেন প্রভুর হাতে গড়া সুন্দর, মনোরম আর নয়নজুড়ানো ভুবন ভুলানো দৃশ্য।
কাশ্মীরের প্রকৃতি নিয়ে কত কবি কবিতা লিখেছেন। কত গল্পকার লিখেছেন শত শত পৃষ্ঠার রচনা। সাজিয়ে তুলেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের লেখাগুলো পড়ে পড়ে কাশ্মীরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে বারবার উঁকি দিত। উদ্বেলিত হতো প্রাণ।
কাশ্মীরের প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলাম মূলত সেই অনেক আগে থেকেই। অবশেষে সে প্রেমকে কাছ থেকে অনুভব করতে পূর্বের প্ল্যান মতে একদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম। কাশ্মীরের উদ্দেশে যখন কামরা থেকে বের হই তখন হৃদয়ে অন্যরকম এক অনুভূতি খেলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ সময়টির প্রতীক্ষায় ছিলাম।
আমাদের কাফেলায় সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন। সবাই আমার খুব বেস্ট ফ্রেন্ড। ট্রেনের টিকিট কেটেছি অনেক দিন হলো। ট্রেন ৬টা ৫০ মিনিটে দেওবন্দ স্টেশনে পৌঁছাবে৷ তাই দেরি না করে আসরের নামাজ পড়েই বের হয়ে গেলাম স্টেশনের উদ্দেশে।
ট্রেনের নাম সালীমার এক্সপ্রেস। খুব ভালো। সাধারণত লেট হয় না৷ প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছায় দেওবন্দ স্টেশনে৷ তাই আধাঘণ্টা আগেই এসে বসে থাকলাম স্টেশনে৷ কাশ্মীর সফর৷ অন্যরকম আবেগ৷ দীর্ঘ প্রত্যাশা এবার পূরণ হতে চলছে৷ অপেক্ষাটাও যেন আমাদের জন্য আনন্দের ছিল৷ কিন্তু
একটু পরই স্টেশন মাস্টার ঘোষণা করল, “মুজাফফরনগর ট্রেনের রাস্তায় সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই ট্রেন আসতে দু’তিন ঘণ্টা লেট হতে পারে।”
স্টেশনে বসে অপেক্ষা করতে বিরক্ত লাগছিল৷ অপেক্ষা জিনিসটা এমনিতেও বিরক্তিকর৷ কিন্তু কি আর করার! সামনে তো আমার জন্য বিরাট আনন্দ অপেক্ষা করছে। তাই হালকা বিরক্তি সহ্য করে নিতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ট্রেন আসার কথা ছিল সন্ধ্যে ৬টায়। কিন্তু এসে পৌঁছাল রাত ৩টায়৷ সময়টা খুবই বাজে কেটেছিল৷ না পারি ঘুমুতে, না ঠিকমতো রিলেক্স করতে৷
যাই হোক ট্রেন আসল। আমাদের সিট হলো স্লিপার s6। খুঁজতে থাকলাম s6 বগি। ট্রেনটা অনেক বড় তাই নির্দিষ্ট সিট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ইতিমধ্যে ট্রেন হর্ন দিয়ে দিল। এই বুঝি ছেড়ে দেবে৷
আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷ সিট খুঁজে না পেয়ে একটি বগিতে উঠে গেলাম৷ উদ্দেশ্য হলো পরবর্তী স্টেশনে সিট খুঁজে নেব৷ আধাঘণ্টা চলার পর ট্রেনটি পৌঁছাল সাহারানপুর। নেট থেকে ট্রেনটির বগি ক্যালেন্ডার দেখে আমাদের সিট অবশেষে খুঁজে পেলাম৷
আজ পূর্বাহ্ণ জম্মু এসে পৌঁছালাম৷ জম্মু থেকে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর যেতে প্রায় ১০ ঘন্টা লাগে৷ কিন্তু কীভাবে যাব? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতে পরে গিয়েছিলাম৷ ঠিক ওই মুহূর্তে পরিচয় হলো কাশ্মীরের বন্ধুভাই জাবেদের সঙ্গে৷ তার আন্তরিকতা দেখে সত্যিই আমি হতভম্ব৷
পাঁচ মিনিটের পরিচয়ের অচিন দেশের অচেনা এক মানুষের জন্য কেউ কি এমন করে! আমাদের উনি প্রাইভেটকার ভাড়া করে দিলেন৷ এবং বললেন, কাল যেন নিশ্চয় উনার বাসায় অতিথি হই। বেচারা নাছোড় বান্দা!
অবশেষেআমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন। সত্যি অবাক লাগে! কাশ্মীর যেমন সুন্দর তেমনই কাশ্মীরের মানুষের মনটাও সুন্দর৷এখন আমরা চারজন প্রাইভেটকারে করে কাশ্মীরের একটি অংশ বানিহাল যাচ্ছি। পাহাড়ি রাস্তা যাত্রা করতে ভালোই লাগছে৷
আমরা চারজন অবস্থান করছি কাশ্মীরের বানিহাল এলাকায়। কাল রাত ১২টায় এসে পৌঁছেছিলাম বানিহালে। এর আগেই ভাই হুসাইন আমাদের দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন৷ তাই আমরা হুসাইন ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করি৷
হুসাইন ভাইয়ের আবাস্থল হলো, বানিহালের খাড়ি নামক মহল্লায়৷ খাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে দুবার আর্মি চেকিং এ ইন্টারভিউ ফেস করতে হয়েছে৷ সর্বশেষ রাত ১২টায় পৌঁছালাম গন্তব্যস্থলে৷ হুসাইন ভাই আমাদের জন্য এত রাত অবধি জাগ্রত ছিলেন৷
সকালে শ্রীনগর যাওয়ার ট্রেন আছে কিনা খবর নিতে বললাম৷ কাল কাশ্মীরে হরতালের কারণে ট্রেন বন্ধ ছিল। খবর আসল, আজ ট্রেন চালু হয়েছে৷ সিদ্ধান্ত হলো বেলা ১১টা পর্যন্ত বানিহাল এলাকা ঘুরে নেব৷ ১২টায় আমরা কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের দিকে রওনা দেব।
তাই আমরা সকালের নাশতা করে বের হলাম এলাকাটি পরিদর্শন করতে৷ প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুরলাম৷ বানিহাল পুরোটিই পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। মূলত বানিহাল থেকে মূল কাশ্মীর শুরু৷ এর একাংশ জম্মুর সীমানায়৷ যাই হোক আমরা বানিহালের টেনেল, বড় বড় পাহাড় পরিদর্শন করি৷ বেলা তখন বাজে ১১টা৷ শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা দেব৷ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম৷ রওনা হলাম ট্রেন স্টেশনে। রাস্তার দু’পাশে ইন্ডিয়ান আর্মি দাঁড়িয়ে আছে৷ মনে হচ্ছে মানুষের চেয়ে আর্মিই বেশি৷
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে তাকালে মনে হয় কাশ্মীর হলো দুনিয়ার জান্নাত৷ আর সৈনিকদের দিকে তাকালে মনে হয় কাশ্মীর বুঝি দুনিয়ার জাহান্নাম। অনেকটা ভয় নিয়েই স্টেশনে পৌঁছি৷
খবর আসল একটু আগে আবার ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সরাসরি শ্রীনগরের কোনো গাড়ি নেই৷ তাই আমরা প্রাইভেটকারে প্রথমে থানাবল গেলাম৷ সময় লেগেছে প্রায় চার ঘণ্টা৷ থানাবল থেকে গেলাম পান্থাচোক৷ প্রাইভেটকারে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা৷
কাশ্মীরের জাবেদ ভাই আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন৷ উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো পান্থাচোকেই৷ ততক্ষণে সন্ধা ঘনিয়ে আসে৷ জাবেদ ভাই আমাদের নিজ গাড়ি দিয়ে বাসায় নিয়ে যায়৷ আমরা উনার বাসায় অতিথি হই৷ এবং রাতে অবস্থান করি। জাবেদ ভাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ন করেন৷ আল্লাহ কা শুকর।
ক্যালেন্ডারের পাতায় ৮/৩/১৮ ঈসায়ী। আমরা অবস্থান করছি কাশ্মীরের বাডঘাম জেলার হায়দারপুরা নামক মহল্লায়৷ গত রাতে জাবেদ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ হয়, আজ আমরা বরফের দুনিয়া গুলমার্গ যাব৷
প্রভাতে জাবেদ ভাই আমাদের আশপাশের এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখালেন৷ উনি কাশ্মীরে ল্যান্ড ব্যবসা করেন৷ তাই তার প্রপার্টিগুলোও এই ফাঁকে দেখিয়ে আনলেন৷ অতঃপর সকালের নাশতাটা সেরে রওনা দিলাম গুলমার্গের উদ্দেশে৷
আমার কাছে যা মনে হয়, কাশ্মীরের মানুষ খুবই সহজ-সরল, সাদাসিধে৷ যে যা বুঝায় সে তাই সাদরে গ্রহণ করে। আর এই সরলতাকেই কাজে লাগাচ্ছে আমাদের আহলে হাদিস ভাইরা। আরও অনেক কিছু জানার ছিল কিন্তু সময় সংকীর্ণ হওয়ায় আর পারলাম না৷
প্রায় দু’ঘণ্টা অবস্থানের পর আমরা রওনা দিলাম গুলমার্গের উদ্দেশে৷ দু’পাশে সারি সারি পাহাড়৷ আঁকা-বাঁকা রাস্তা৷ ভালোই লাগছিল। পুরোটা পাহাড় বরফে ভরপুর৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন আঁখিযুগল কেড়ে নিচ্ছিল৷
এর আগে ফটোতে কাশ্মীরের প্রকৃতি অনেক দেখেছি তখন ভেবেছি হয়তো এডিট করা কিন্তু বাস্তবে যে আরও শতগুণ সুন্দর তা হয়তো না আসলে অজানাই থাকত৷
আমাদের গাড়ি যখন গুলমার্গ মূল পয়েন্টে পৌঁছাল তখন বৃষ্টির মতো বরফ পরছিল৷ অনুভূতিটাই ছিল অন্যরকম৷ বরফে ওপর হাঁটাচলা করা, স্কাইডিং করা, স্বচ্ছ বরফ হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলা আমাদের আনন্দকে আরও দ্বিগুণ করে দিচ্ছিল৷
সারকথা, লেখনীতে বা ক্যামেরার ভাষায় এর সৌন্দর্য প্রকাশ করা সম্ভব না৷ যতই বলব ততই কম হবে৷ এককথায় কাশ্মীর অসাধারণ৷ বাস্তবেই তা ভূস্বর্গ৷