চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। লবনাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারনে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় কৃষি জমি কমলেও কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে জলাবদ্ধ ও অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করায় এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২হাজার ৪৮৩ হেক্টর জমিতে বেশি বোরো চাষ হয়েছে। তবে জেলার কয়েকটি স্থানে ধান পাকার মুখে ব্লাষ্ট রোগ দেখা দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এই রোগ আক্রান্ত হওয়ায় আধাপাকা ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জেলায় এ পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে ব্লাষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে মূলত জেলার কয়েকটি স্থানে এই ব্লাষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। দিনে গরম ও রাতে ঠান্ডা পড়ায় বোরো ধানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলার সাতটি উপজেলায় ৭৩ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়ে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয় ৩ লাখ ৬২৬ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৭ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন, কলারোয়ায় ৪৮ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন, তালায় ৭৩ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন, দেবহাটায় ২৫ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন, কালিগঞ্জে ২১ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন, অশাশুনিতে ২৭ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন এবং শ্যামনগরে ৬ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে জলাবদ্ধ ও অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করায় এবার জেলায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭৬ হাজার ৩‘শ ৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক থাকলে বোর ধানের বাম্পার ফলন হবে এবং সুষ্ঠ ভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারলে এবার জেলায় ৭ লাখ ৩০ হাজার ৪‘শ ২০ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন সম্ভব হবে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কৃষক আমিনুর রহমান আলম জানান, তিনি এবার ৫ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। আর কিছুদিন পরে ধান কাট শুরু হবে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে বিঘা প্রতি ১৮ থেকে ২০ মণ ধান পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, এখনো পর্যন্ত ফলন ভাল আশা করছি। তবে এবার ধানে বিক্রির বাজার যদি ভাল না থাকে তবে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এদিকে, ক্ষেতে ধান পাকার সাথে সাথে জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে বোরো ধানে ব্লাষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার রইচপুর ও বাগবাটি, তালা উপজেলার ইসলামকাটি, বড়বিলা, আটারই, হাতবাস, পাঁচরোখি, বারুইহাটি এবং বাইগুনিসহ কয়েকটি গ্রামের মাঠে বোরা ধানে এই রোগ দেখা দিয়েছে। ফলে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের মুখে শেষ মূহুর্তে ব্লাস্ট নামক ছত্রাকের আক্রমণে ওই সব এলাকার কৃষকদের মুখের হাসি একরক ম্লান করে দিয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাগবাটি গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে ৬ বিঘা পরিমান জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। এতে সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা তার খরচ হয়েছে। ক্ষেতের ধানও প্রায় আধা পাকা হয়ে গেছে। কিন্তু ৪/৫ দিন যাবত ধানের শীষ শুকিয়ে ভিতরে চিটা হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রথমে দু‘একটি ধানের শীষে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরদিন ক্ষেতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে জমির অধিকাংশ ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। কিন্ত স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার পরও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। একই কথা জানান, পাশ্ববর্তী রইচপুর গ্রামের গোলাম হোসেন ও আবুল হাসান জানান।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তার রঘুনাথ গুহ বোরো ক্ষেতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বোরো ক্ষেতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ার পর ওইসব গ্রামে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে এটি দ্রুত কমে যাবে।
তালার ইসলামকাটি গ্রামের প্রদীপ ঘোষ, নজরুল ইসলাম, পাঁচরোখি গ্রামের কালাম হোসেন, বারুইহাটির সাত্তার সরদার, আটারই গ্রামের মোঃ আলাউদ্দীন জানান, চলতি এপ্রিলে মাঠে ধান পাকতে শুরু করেছে। কোন কোন এলাকায় কেবল ভারী হয়েছে শীষ। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্ষেতের আধা পাকা ধান চিঠা হয়ে যাচ্ছে। পরে কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ধান পাকার মুখে এই রোগ দেখা দেয়ায় তারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে তালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শামছুল আলম জানান, ব্লাস্ট ছত্রাক ধানের শীষ শুকিয়ে দেয়ায় চিটার পরিমাণই বেশী হয়। যে সব এলাকায় এই রোগ দেখা দিয়েছে সেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিঘা প্রতি ৫/৬ মন ধান কম হতে পারে। তবে এবিষয়ে চাষীদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি বক সুপারভাইজাদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কাজী মো. আব্দুল মান্নান জেলার তালা ও সদর উপজেলাসহ কয়েকটি স্থানে বোরা ধানের ব্লাস্ট রোগ আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এবছর জেলায় ৭৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার হেক্টর বেশী। সম্প্রতি প্রতিকুল আবহাওয়া যেমন দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা, মেঘলা আবহাওয়া, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এবং বাতাসের কারনে কিছু কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে বোরো ফসলে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগ দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত এলাকায় কৃষি বিভাগ থেকে সার্বক্ষনিক বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রযোগ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। নতুন করে এই রোগ আর দেখা দেবেনা বলে আশ^াস এই কর্মকর্তার। সার্বক্ষণিকভাবে এ রোগ নিরাময়ে বিভিন্ন প্রচার প্রাচরণা চালানো হচ্ছে বলে তিনি আরো জানান।
Check Also
২৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হচ্ছে সাতক্ষীরা—শ্যামনগর সড়ক
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়া সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর পর্য়ন্ত ৬২ কিলোমিটার সড়ক …