মোহাম্মদ সফিউল হক : আমাদের দেশ বাংলাদেশ। বড় অদ্ভুত সুন্দর আর মায়াময় একটি দেশ। ভাষার বৈশিষ্ট্যও অদ্ভুত (ফিক্সড স্ট্রাকচার নেই অথবা অনেক ফ্লেক্সিবল। যেমন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’, ‘তোমাকে ভালোবাসি আমি’, ‘আমি ভালোবাসি তোমাকে’, এর সবই সঠিক), মানুষগুলো অদ্ভুত (বাঙ্গালীদের মধ্যে বেটে, খাটো, মাঝারী, বেশ লম্বা, কালো, শ্যামলা, ফর্সা, নাক বোঁচা, নাক উঁচু সহ সব বৈশিষ্টের মানুষই আছে), দেশের রাজনীতি অদ্ভুত (বিতর্ক অপ্রাসঙ্গিক), ঋতুগুলো অদ্ভুত (দুনিয়ার আর কোথায়ও ৬ টা ঋতু নেই!), আমাদের দেশের প্রায় জাতীয় ঝড় ‘কালবৈশাখী’, সেটাও মন ভার করে দেয়া অদ্ভুত আবেদনময়ী। আর আমাদের এই অদ্ভুত সুন্দর দেশের একটি উৎসবের উপলক্ষ্য পহেলা বৈশাখ। যে উৎসবের মাধ্যমে বাঙালী তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়কে খুঁজে পায়, জীবনের বিষাদময় একঘেয়েমিকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি পায়। বাঙ্গালী, বাংলাভাষীদের মতই নানা উপজাতির লোকেরাও প্রায় একই সময়ে মেতে ওঠেন প্রাণের উৎসবে। এই উৎসব শতবর্ষ ধরে এই জনপদের একটা অকৃত্রিম, মাটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া প্রাণের উৎসব।
বাংলা নববর্ষ পালনে ইরান ও আরবের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদযাপন ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের যোগসূত্র লক্ষণীয়। ১২০১ খ্রিস্টাব্দ, ৫৯৮ হিজরি মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। তখন চান্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনারীতিতে পার্থক্যে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কারণ সূর্য নিজ কক্ষপথে ঘুরতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। যা হলো সৌরবর্ষ। আবার চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধিতে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা। যে কারণে এক চান্দ্রবছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট।মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে ‘উশর’ ও ‘খারাজ’ তথা মুসলমানদের ফসলি কর ও অমুসলিমদের ভূমি কর আদায়ের ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের গণনারীতির ব্যবধানে তৈরি হয় জটিলতা। কেননা ওই দুই বর্ষপরিক্রমায় তৈরি হয় ১১ দিন ব্যবধান এবং ৩৩ বছরে পার্থক্য হয় এক বছর! বাস্তবে দেখা গেল, হিজরি সালের হিসাবে যখন কর আদায়ের সময়, তখন কৃষকের মাঠে ফসলও থাকত না।
‘মুসলিম ফসলি সন’ প্রবর্তনের আগে অগ্রহায়ণ থেকে বছর গণনা হতো। ‘অগ্র’ অর্থ শুরু, ‘হায়ণ’ অর্থ বছর। অন্য মতে, ‘অগ্র’ অর্থ শ্রেষ্ঠ, ‘হায়ণ’ অর্থ ধান। কেননা এ সময় প্রধান ফসল আমন বা শ্রেষ্ঠ ‘হৈমন্তিক’ ধান কৃষকের ঘরে ওঠত। তবে বর্ষা শেষে খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের অসুবিধা বিবেচনায় তা শুষ্ক মৌসুমে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি একটি নতুন সৌর সন উদ্ভাবন করেন। তিনি হিজরি সনের ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধরে যে নতুন সন উদ্ভাবন করেন, তা-ই ‘বাংলা সন’ হিসেবে প্রচলিত। সম্রাট আকবর ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন গণনা করেন এবং সূচনা বছর হিসেবে ধরা হয় তাঁর মসনদে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ৯৬৩ হিজরিকে । দেখা যায়, আকবরের ‘ফসলি সন’ যখন চালু হয়, তখন সুবে বাংলায় মহররমে ছিল বৈশাখ মাস। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস হয়ে গেল বৈশাখ মাস। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের গণনারীতির ব্যবধানে কালের বিবর্তনে দেখা যাচ্ছে এখন হিজরি ১৪৩৯ এবং ১৪ এপ্রিল শনিবার ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ সাল। এ থেকে জানা যায়, আমাদের বাংলা নববর্ষে ঐতিহাসিক হিজরত ও হিজরি সনের স্মৃতি মিশে আছে। বঙ্গাব্দের সূচনা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক রাখার জন্য বাংলা একাডেমির পক্ষে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বছরের শুরুর পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষ মাসগুলো ৩০ দিন নির্ধারণ করেন এবং আশির দশকে বাংলা একাডেমি ৮ ফাল্গুন ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক রাখার জন্য খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে মিলিয়ে অধিবর্ষ নির্ধারণ করে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন প্রচলন করেন। আকবরের সময় চন্দ্রাব্দ হিজরি থেকে ফসলি সনকে সৌরাব্দে রূপান্তরিত করা হয়েছিল রাজ্যের সুবিধার জন্য। এর বাইরে বাংলা সনের বিশেষ কোন সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিলো না।
ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত যে আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপনের কোন ধারণা বা রেওয়াজ ছিলো না। আমরা দেখতে পাই বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কাব্যে ঋতু, প্রকৃতি, সমাজচিত্রের কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু কোথাও নববর্ষের কথা উল্লেখ নেই। এছাড়াও ভারতবর্ষের প্রচীন ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল-বেরুনীর ভারততত্ত্বেও’ নববর্ষের কোন উল্লেখ নেই। আর তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় যে বঙ্গাব্দের শুরু থেকেই উৎসব ছিল তাহলেও হাজার বছর দূরের কথা পাঁচশত বছরের বেশি হয় না। এসব ধারণা আমরা কিছুটা পেয়েছি মোগল আমলে ইরানী সভ্যতার ‘নওরোজের’ প্রভাবে এবং পরবর্তীকালে পশ্চিমাদের ‘হ্যাপী নিউ ইয়ার’ পালনের কায়দা-কানুন অনুকরণ করে।
চৈত্রের শেষ দিনে হিন্দুরা চৈত্রসংক্রান্তি পালন করতো, যা তাদের তের পার্বণের একটি। পহেলা বৈশাখ থেকে দু’একদিন বা সপ্তাহব্যাপী চড়কপূজা করতো এবং পূজা উপলক্ষে মেলা বসতো। এছাড়াও ঘটপূজা, গণেশ পূজা, সিদ্ধেশ্বরী পূজা, মঙ্গলশোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল প্রার্থনা প্রভৃতি উৎসব হিন্দুরা পালন করতো। অপরপক্ষে আমরা দেখতে পাই বাংলা বর্ষের সূচনা মুসলমানদের হাতে, মোগলরা এই সময় উশর, খারাজ, ভূমি কর গ্রহণ করতো। জমিদাররা ঐদিন বার্ষিক রাজস্ব নবাবের কোষাগারে জমা দিত। গ্রামের লোকেরা নববর্ষে কখনো পান্তা ভাত খেতো না, বছরের অন্যদিনগুলোতে কষ্টে কাটালেও এই দিনে একটু ভাল খাবার চেষ্টা করতো, ঘর-বাড়ী ভালভাবে পরিষ্কার করতো, একে অন্যের খোঁজ-খবর নিত। এভাবেই চলে আসছিলো আমাদের সমাজ।
পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে এখন বলা হচ্ছে আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। অথচ বিশেষজ্ঞরা ও নথিপত্র বলছে, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পহেলা বৈশাখের ‘পান্তা-ইলিশে’র কোনো দূরতম সম্পর্ক নেই। বরং পান্তার মধ্যে আছে প্রান্তিক অভাবী মানুষের কথা। গ্রাম কিংবা শহরের প্রান্তিক মানুষের একটি নিরুপায় অবলম্বন হলো পান্তাভাত।যতদূর জেনেছি ১৯৮৩ সালে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এই পান্তা ইলিশের সংযোজন ঘটে। তখন দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ এই পান্তা ইলিশ যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। এ প্রসঙ্গে বাংলার ঐতিহ্যের গবেষক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক প্রফেসর শামসুজ্জামান খান জানান, “বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে ইলিশের কোন সম্পর্ক নেই। বৈশাখে যখন খরার মাস যখন কোনো ফসল হতো না তখন কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো।” চিন্তাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার এক লেখায় বলেন, “গরিব মানুষের খাবার পান্তাভাত। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনও উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।”
নববর্ষের উৎসবে এখন যুক্ত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণা এসেছে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল কাব্য, মঙ্গল ঘট ও মঙ্গলগীতের ভাব ও মাহাত্ব্য থেকে। মঙ্গল শোভাযাত্রা মানে হলো মঙ্গল কামনা করে অশুভ বিতাড়নের জন্য যে যাত্রা। এই শোভাযাত্রায় সবসময় বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন থাকে। যেমন: লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস, গণেশের বাহন ইঁদুর, দুর্গার বাহন সিংহ, মনসার বাহন সাপ, কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর, মহাদেবের বাহন ষাঁড়, যমরাজের বাহন কুকুর, ইন্দ্রের বাহন হাতি, ব্রহ্মার বাহন পাতিহাঁস, বিশ্বকর্মার বাহন ঢেঁকি, শীতলার বাহন গাধা ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়।
পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে যেগুলো ঈমানÑ আক্বিদার পরিপন্থি সেগুলো বাদ দেয়া যেতে পারে। বৈশাখি মেলায় যাওয়া, বেলুন ও ঘুড়ি ওড়ানো, নাগরদোলায় চড়া, পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, দোকানে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে বর্তমানে সারাদেশের সাধারণ মানুষ নববর্ষ উদযাপন করে।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …