মইনুল হোসেন: দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে যারা দেশের কোটি কোটি মানুষকে পাকবাহিনীর ট্যাংকের মুখে রেখে প্রতিবেশী দেশে চলে গিয়েছিল, তাদের মুখ থেকে দেশের অভ্যন্তরে নিরন্তর পাক সেনাদের গুলির মুখোমুখি যুদ্ধরত কোটি কোটি মানুষকে সুবিধামতো রাজাকার বলে আখ্যায়িত করার অপরাজনীতি অনেক সহ্য করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু নিজেও ভারতে আশ্রয় নেয়ার প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের মুখ থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে জড়িত দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ উচ্চারণ চরম ধৃষ্টতা, অন্যায্য ও অনাকাক্সিক্ষত। আমাদের জনগণকে বিভক্ত করে এক অংশকে অপর অংশের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত করার ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে।
কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতা থেকে প্রমাণিত হয় তারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। এখনও তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় খুশি নয়। তারা বৃহত্তর কোনো আশা লালন করে যাচ্ছে।
সরকারের হিসাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক অসহায়ভাবে প্রাণ হারিয়েছে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের দুর্গ’ গড়ে তোলার জন্য তখন অনেককেই পাওয়া যায়নি। যারা যুদ্ধের হুমকি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করেছিল, জনগণের প্রতি এই প্রতিশ্রুতির কথা তারা স্মরণে রাখেননি। যুদ্ধের জন্য তাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না, তারা বঙ্গবন্ধু ও জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে।
পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক খোলা আকাশের নিচে আমাদের লোকদের নিষ্ঠুর হত্যার সময় এই সব সাহসী লোকেরা জনগণের দুর্ভোগে জনগণের পাশে ছিল না। আমরা তখন তাদের সাহসের চর্চা দেখিনি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু প্রস্তুতির অভাবে ৩০ লাখ মা-বাবা, ভাই-বোন পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর শিকার হয়ে করুণভাবে প্রাণ দিতে বাধ্য হয়েছে। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর অংশ নিয়ে কেউ তেমন চিন্তাও করে না। ইতিহাসের এই হৃদয়বিদারক অংশ কিছু নেতা হৃদয়ঙ্গম করতে চাইছেন না।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, জনগণকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা চলে গেল ভারতে। যখন তারা ফিরে এলো, জনগণ তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারত যে, তাদের এভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি অসহায় অবস্থায় রেখে কেন তারা চলে গিয়েছিল। পাকবাহিনীর অত্যাচারে যখন আমাদের জনগণ নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল, তখন তাদের মৃত্যুযন্ত্রণার সময় বা মৃতদের জন্য সহমর্মিতা জানানোর কেউ ছিল না।
আমাদের জনগণ সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করে ভারতসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ ও ত্যাগ স্বীকার না করলে আজ জনগণকে রাজাকার বলার ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগই ছিল না। তাদের জানা উচিত, মানুষের জীবন ও দেশপ্রেম সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যাকে-তাকে যখন-তখন বিশ্বাসঘাতক বলবেন না। ভারতে গেলেই কারও দেশপ্রেম প্রমাণিত হয় না।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো তারা অভ্যন্তরে থেকে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলার জন্য সামান্যতম চেষ্টা বা অপেক্ষাও করেনি। নেতৃত্বহীন অবস্থায় জনগণ কসাইয়ের ছুরির শিকার হল। আমাদের জনগণকে নিরস্ত্র অবস্থায় পাকবাহিনীর বর্বরতা মোকাবেলা করার জন্য রেখে যাওয়া হল, জনগণের পাশাপাশি যুদ্ধ করার প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করে তারা চলে গেলেন ভারতে। এই প্রতিশ্র“তি ভঙ্গের কথা সদয় জনগণ একবারও জিজ্ঞেস করেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অবাধ্যতার কারণে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ যারা সাক্ষাৎ করেছিলেন তারা হলেন- তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট পরামর্শ ছিল দেশের ভেতর ছড়িয়ে পড়ো। যেসব নেতা ভারতে চলে গেলেন, তাদের কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের স্বাধীনতার সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। দখলদার পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতা সেদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছিল।
এমনকি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও স্বীকার করবেন যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো কোনো প্রস্তুতি আমাদের নেতাদের ছিল না। ব্যর্থ রাজনীতির চরম মূল্য দেশে থাকা জনগণকে দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যারা ভারতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করেছেন, তাদেরই এর দায়িত্ব নিতে হবে, ব্যাখ্যা দিতে হবে। মানুষের জীবন-মরণকে তুচ্ছ করার রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই।
আমাদের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করার প্রস্তাব দিলে তাদের তখন বারণ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারকে সন্দেহ করা হয় এবং তাকে তৎক্ষণাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
অবশেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। এভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেল ‘পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ’। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করল তখন একজন মাত্র সেক্টর কমান্ডার ছাড়া আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো লোক সেখানে উপস্থিত ছিল না। পাকিস্তান সেনারা হয়ে গেল ভারতের যুদ্ধবন্দি- বাংলাদেশের নয়। আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী সৈনিকদের বিচার আমরা করতে পারলাম না।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এসব অজানা কাহিনী বর্ণনা করার অর্থ এই নয় যে, ভারতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে দেখা।
যারা মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি বিশেষ শ্রেণী হিসেবে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখলে রাখার চিন্তা করছেন, তারা বস্তুত আমাদের মধ্যে কম্যুনিস্ট কায়দায় শ্রেণীসংগ্রাম (Class struggle) বাধাতে চাচ্ছেন। তারা আদতে আগুন নিয়ে খেলছেন। সমাজে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নীরব ও শান্ত, তারা কোনো অশুভ রাজনীতির নীলনকশার ক্রীড়নক হতে চায় না।
সরকারি কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন প্রমাণ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াও আমাদের তরুণ সমাজ সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে পারে এবং চক্রান্ত ও নাশকতার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে।
নিরস্ত্র ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের বর্বর আক্রমণের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। পুলিশের উচিত নয় সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গ হওয়া। নিরপেক্ষ পেশাভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে নিজস্ব ভাবমূর্তি সংরক্ষণ করা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। এখন প্রমাণিত হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসা ভাঙচুর করেছে পেশাজীবী অভিজ্ঞ লোকেরা। আন্দোলনকারী ছাত্ররা নয়। আমাদের শাসনব্যবস্থা কত গণবিরোধী হয়েছে তা সবাইকে ভাবতে হবে। দেশপ্রেমিক কারও চুরির টাকায় বিদেশে ভালো থাকার চিন্তা থাকতে পারে না।
আমাদের দলীয় রাজনীতি হয়ে পড়েছে ষড়যন্ত্রভিত্তিক ও বিভক্তিমূলক- জ্ঞানভিত্তিক নয়। অন্যের শক্তির ওপর নির্ভর করে বড় বড় কথা বলা রাজনীতি নয়। আমাদের দলীয় রাজনীতি গড়ে উঠেছে পারস্পরিক অনাস্থার ওপর। দলীয় নেতারা একদল অপর দলকে শত্রু মনে করে। শুধু কোটা পদ্ধতির সংস্কারই নয়, আমাদের রাজনীতিরই জরুরি ভিত্তিতে আমূল সংস্কার প্রয়োজন।
সম্প্রতি সুশৃঙ্খল অহিংস ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতির বিদ্যমান এই দেউলিয়া অবস্থায় ছাত্রদের মধ্য থেকে চরিত্রবান ও সাহসী নেতৃত্ব অবশ্যই বের হয়ে আসবে। হতাশ জাতির মনে কিছুটা হলেও নতুন আশার সঞ্চার করেছে তারা।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ