নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশ সফরে আ’লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সমর্থন চাইবে * মূল টার্গেট প্রতিবেশী ভারত-চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন * বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও সহিংস আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরবে প্রতিনিধি দল

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:   আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা, খালেদা জিয়ার দুর্নীতি ও কারাবাস, বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরতে আওয়ামী লীগ নেতারা বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও থাকবে এসব সফরে।

দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে তিক্ত মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল তা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টাও থাকবে এতে। যদিও বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ নিরসনে জিরো টলারেন্স, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের প্রশংসার কাছে এরই মধ্যে অনেকটা চাপা পড়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আজ (রোববার) ভারত সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী মিশনে নামছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারত যাচ্ছে। এরপর আওয়ামী লীগ সফরে যাবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায়। পৃথক টিমের মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন ও কূটনীতিক তৎপরতা জোরালো করতে এসব সফর হবে।

ভারত সফরে প্রতিনিধি দল দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। একই সঙ্গে বিরোধী দল কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, সভাপতি রাহুল গান্ধী, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে আওয়ামী লীগের এ প্রতিনিধি দলের।

এছাড়া তিস্তা পানি চুক্তি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও বৈঠকের সম্ভাবনা আছে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলটির। সফর তালিকায় থাকা প্রতিনিধি দলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, সফরে বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে আরও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে গুরুত্বারোপ করা হবে।

আরেক প্রতিবেশী দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে তারও ব্যাখ্যা এবং আশ্বস্তের কথা থাকবে এ সফরে। সফরে বাংলাদেশের উন্নয়ন, জঙ্গিবাদ নিরসনে আওয়ামী লীগের সফলতা, দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ বাজায় রাখা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি ও কারাবাস, জামায়াত সংশ্লিষ্টতা, বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও এবং মানুষ হত্যার রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে আলোকপাত করবে আওয়ামী লীগের এই প্রতিনিধি দল। একই সঙ্গে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সমর্থন চাইবে প্রতিনিধি দলটি।

সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর এটি ওবায়দুল কাদেরের দ্বিতীয় ভারত সফর। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর দু’দিনের সফরে ভারত যান তিনি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, আমরা ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে ভারত যাচ্ছি। এ সফরের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির সম্পর্ক মজবুত হবে।

ভারত সফর নিয়ে শনিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ওবায়দুল কাদের। ধানমণ্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটি মূলত পার্টি টু পার্টি প্রোগ্রাম। এখানে তাদের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া বাড়বে। স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তবে ইন্ডিয়া মোর দ্যান এ নেইবার।

তিনি বলেন, আমাদের ক্ষমতার উৎস বাংলাদেশের জনগণ। বিজেপি এসে আমাদের জন্য ভোট চাইবে না, চাইতেও পারবে না। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির একটা বিউটি আছে। তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। অন্যান্য দেশ এ বিষয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করে। অনেক দেশ ছোটাছুটি করে। কিন্তু ইন্ডিয়া এগুলো করে না।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল তিন দিনের এ সফরে প্রতিনিধি দল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিজেপির শীর্ষ নেতা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবে।

এদিকে সদ্য শেষ হওয়া ২৫তম কমনওয়েলথ সম্মেলনে ৫৩টি দেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে সংগঠনটিও। একই সঙ্গে যে কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ব নেতারা।

এখানেই শেষ নয়; কমনওয়েলথ সম্মেলন চলাকালীন তিস্তা ইস্যুসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানা গেছে।

মে মাসের শেষের দিকে কলকাতার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করতে ভারত যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-মোদি-মমতা বৈঠকে তিস্তা নিয়ে সুসংবাদ পেতে পারে বাংলাদেশের মানুষ।

আগামী নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বর্তমানে এটিই বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগের। ১৯ সদস্যের টিমের ভারত সফর সে ক্ষেত্র তৈরিরও প্রয়াস চালাবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত সফর হচ্ছে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে। চীন সফর হবে সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে। একইভাবে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়ায় পৃথক টিমের মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন ও কূটনীতিক তৎপরতা জোরালো করতে সচেষ্ট থাকবে।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশে ১৪ দলীয় জোটের প্রগতিশীল নেতাদেরও কাজে লাগাবে আওয়ামী লীগ। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা কিংবা উন্নয়ন করা। এদিকটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগের একাধিক টিম ভারত সফর করেছে।

১৭ মার্চ ভারত সফর করেছে আওয়ামী লীগের আরেকটি প্রতিনিধি দল। তিন সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি ১৯ মার্চ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। রাহুল গান্ধী বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি এবং সন্ত্রাস মোকাবেলার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

প্রতিনিধি দলে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও দফতর উপ-সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। কংগ্রেসের আমন্ত্রণে প্রতিনিধি দলটি ভারত সফর করে বলে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। আওয়ামী লীগের এ প্রতিনিধি দলটি কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ অন্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের মতো চীনেরও পর্যবেক্ষণ আছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই ৩০ নভেম্বর তিন দিনের সফরে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল চীন ঘুরে এসেছে। সফরে তারা চীনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেন।

চীনা প্রেসিডেন্ট ও দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে তারা এ সফর করেন। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জমির, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ হুমায়ুন প্রতিনিধি দলে ছিলেন।

সফরে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। উপস্থিত অং সান সু চির সঙ্গেও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন তারা। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে একটি বড় ইস্যুই দাঁড় করায় প্রতিনিধি দলটি। পরে বিষয়টি নিয়ে তুরস্ক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আলজেরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের নেতারা তাদের বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য চীন ও মিয়ানমারকে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানায়। বিষয়টি আওয়ামী লীগের চীন সফরের সফলতা হিসেবেই সে সময় উল্লেখ করে দলটি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার রায়ের আগে-পরে বিদেশি কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে নানা চেষ্টা করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এখনও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তারা। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বিদেশ মিশন গতি পাওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ কূটনীতিক তৎপরতা বাড়াল। এ মিশন আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রশংসায় ভাসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষ নেতৃত্বের কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী শীর্ষ নেতৃত্বের খেতাবধারীও এখন তিনি। তাছাড়া বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিকভাবে উন্নীত হয়েছে, এজন্যও তিনি বিশ্বে প্রশংসিত। এছাড়া আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা থেকে শুরু করে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে।

যদিও এক সময় এসব দেশের অনেক নেতা শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করেছিল। কিন্তু এখন সে সমালোচনা মুছে গেছে। সাড়ে চার বছরে নেয়া সরকারের নানা উদ্যোগের কারণেই এমন ইতিবাচক পরিবর্তন এবং এটি আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় সফলতা বলেও দাবি দলটির নীতিনির্ধারকদের।

আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সামনে নির্বাচন। বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কূটনীতিক পর্যায় থেকে ইতিবাচক-নেতিবাচক কোনো মন্তব্য আসেনি।

একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী দেশসহ অন্য দেশ যারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটিও করবে বিদেশ সফরকারী প্রতিনিধি দলগুলো। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ সফর অব্যাহত থাকবে বলেও জানায় সূত্রটি।যুগান্তর

Check Also

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে : অ্যাটর্নি জেনারেল

র্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।