আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা: ধান ও বিচালির দাম চড়া থাকায় সাতক্ষীরায় বোরো চাষীরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। খরচ বাদ দিয়ে বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার পর্যন্ত লাভ হচ্ছে তাদের। উৎপানের শুরুতে ধানের এত দাম পেয়ে কৃষকরা আনন্দে আতœহারা। শ্রমিকরা ও দৈনিক ৫শ থেকে ৬শ টাকা শ্রম পেয়ে বেজায় খুশি। কিন্তু ধান কাটাশ্রমিক সংকটের কারণে দিশেহারা ধান চাষীরা। সময় মত পাকা ধান ঘরে তুলতে না পেরে তারা দিশেহারা।
যে দিকে চোখ যায় মাঠের পর মাঠে এখন কৃষকের সোনালি স্বপ্ন যেন বাতাসে দোল খাচ্ছে। সোনালি ধানের শীষে ভরে উঠেছে জেলার মাঠ। সেই সাথে রঙিন হয়ে উঠছে চাষিদের স্বপ্ন। মাঠজুড়ে এখন সোনালি ধানের ছড়াছড়ি।
কিন্তু কৃষিশ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকের সেই স্বপ্ন অনেকটা মিলান। স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক থাকায় ধানকাটা শ্রমিকের মজুরিও চড়া। শ্রমিকের অভাবে কৃষকরা ধান কাটতে পারছেন না। এক সঙ্গে জেলার বেশিরভাগ খেতের ধান পাকায় শ্রমিক নাপেয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে। দূর-দূরান্ত ঘুরেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি বৈশাখের শুরুতে এ অঞ্চলের কৃষকরা ধান কাটা শুরু করে। বর্তমানে পুরাদমে ধান সংগ্রহ চলছে। চলতি মওসুমে সময়মতো বৃষ্টি এবং অনুকূল আবহাওয়া থাকায় অন্য সব বছরের চেয়ে এবার ইরির আবাদ ভালো হয়েছে। আশানুরূপ ফলন পেয়ে কৃষকরা বেজায় খুশি।
কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ অঞ্চলে কৃষিশ্রমিক সংকটের পেছনে রয়েছে পেশা পরিবর্তন। মৌসুমি কাজের ভরসায় না থেকে মানুষ অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে এই পেশা পরিবর্তনের কারণে এবার ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক।
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখছে না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার এ জন্য ‘খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টর’ নামের একটি যন্ত্র এ বছর কৃষকদের দেখানো হচ্ছে। ৩০ শতাংশ ছাড়ে যন্ত্রটি প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের সরবরাহ করা যাবে। তবে দাম বেশি হওয়ায় কৃষকেরা এটি কিনতে পারছেন না।
শনিবার বিলেলে সাতক্ষীরা শহরের কুকরালি বিলে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক সিরাজুল তার,মা,বাবা,ছোট ভাই, স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে ধান ঝাড়তে।সিরাজুল জানালেন, শ্রমিক সংকট ও শ্রম মূল্য অনেক বেশি হওয়াতে তাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে ধান ঘরে তুলার কাজ করছে। দ্রুত না তুলতে পারলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
তিনি জানান,এবছর তিনি সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে ইরির আবাদ করেছেন। ধানের ফলন ও ভাল হয়েছে। বিঘা প্রতি ১৮ থেকে ২০ মণ ধান উঠতে পারে। এতে তার খরচ বাদ দিয়ে বিঘাতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাভ থাকবে।
খলিষখালির কৃষক আব্দুস সালাম বিশ্বাস জানান, বর্তমানে জেলাতে আঠাশ ধান ( চিকন চালের) এর মণ এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে যদি ২০ মণ ধান হয় তা হলে বিশ হাজার টাকা বিক্রি হবে। অন্যদিকে বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। ধানের দাম বেশি থাকায় এবছর কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে।
তালার বাগমার গ্রামের কৃষক আব্দুল আহাদ বলেন, এক বিঘা জমি আবাদ করতে ছয় থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন ধান কাটার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকদের একটি অংশ স্বাবলম্বী, আর কেউ কেউ শহরে গিয়ে কাজ করছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরা ধান কাটার জন্য চড়া দাম হাঁকছেন। কাছের জমি বিঘাপ্রতি চার ও দূরে হলে সাড়ে চার হাজার টাকা চাইছেন।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, এবার সাতক্ষীরাতে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে। এখনো ৩০থেকে ৪০ শতাংশ জমিতে ধান রয়েছে। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকেরা চিন্তিত।
এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, সারা দিন রোদে পুড়ে এই কাজ করে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পাওয়ার চেয়ে শহরে গিয়ে অটোরিকশা চালিয়ে ৩০০ টাকা পেলেও শরীরটা আরামে থাকে। মানুষের মধ্যে পেশা পরিবর্তনের এই প্রবণ বাড়ছে।
শ্যামগনরের দাতিনা খালি গ্রামের কৃষক বাবলুর রহমান জানান, আগে কৃষি কাজ করতাম। কিন্তু সারা বছর কাজ থানা থাকায় এখন সাতক্ষীরা শহরে রিকশা চালায়। এমন অবস্থা আরো অনেকের। এছাড়া বিদেশে যাওয়ার প্রবর্ণতা বেড়েছে অনেক। অন্যদিকে চিংড়ি চাষের ফলে কৃষকের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।
জলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলার সাতটি উপজেলায় ৭৩ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয় ৩ লাখ ৬২৬ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৭ হাজার ৫১৭ েেমট্রিক টন, কলারোয়ায় ৪৮ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন, তালায় ৭৩ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন, দেবহাটায় ২৫ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন, কালিগঞ্জে ২১ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন, অশাশুনিতে ২৭ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন এবং শ্যামনগরে ৬ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন । আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে জলাবদ্ধ ও অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করায় এবার জেলায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭৬ হাজার ৩‘শ ৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক থাকলে বোর ধানের বাম্পার ফলন হবে এবং সুষ্ঠ ভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারলে এবার জেলায় ৭ লাখ ৩০ হাজার ৪‘শ ২০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন সম্ভব হবে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কাজী মো. আব্দুল মান্নান এবছর জেলায় ৭৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার হেক্টর বেশী। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে ধান তুলতে একটু সমস্যা হচ্ছে। দু’এক সপ্তাহের মধ্যে সব ধান কৃষকরা ঘরে তুলবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো জানান ধানের দাম বেশি থাকায় ধান চাষে কৃষকরা বেশি আগ্রহী।