ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট : এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবারও পাসের হার কমেছে। শুধু তাই নয়, গত নয় বছরের মধ্যে এসএসসিতে এবারই সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে আড়াই শতাংশের বেশি। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে পৌনে ছয় হাজার। ইংরেজি, গণিত ও রসায়নে পাসের হার হ্রাস, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি, প্রশ্ন ফাঁসের নেতিবাচক প্রভাব, নকলের সুযোগ কমে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চল বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ফল খারাপ হওয়া- এ পাঁচ কারণে মূলত সার্বিক পাসের হারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১০টি শিক্ষা বোর্ডের ৯টিতেই এবার পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। তবে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার ২১ শতাংশ বেশি হওয়ায় পাসের হারের নিম্নগতি কিছুটা রোধ হয়েছে।
এবার মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডে ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ। এবার শুধু এসএসসিতে অংশ নেয় ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪২৩ জন, পাস করেছে ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৮০৫ জন। এবার ১০ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন। গত বছর পেয়েছিল এক লাখ চার হাজার ৭৬১ জন। গতবারের চেয়ে এ সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ হাজার ৮৬৮টি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এবারে এসএসসিতে পাসের হার গত নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১০ সালে পাসের হার একলাফে বেড়ে যায় ১১ শতাংশ। ওই বছর পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ১৯ ভাগ। ২০০৯ সালে মোট পাস করেছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাসের হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসিতে মোট পাস করেছিল ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে এসএসসিতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর পাসের রেকর্ড ছিল। ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি পাস করেছিল ওই বছর। ২০১৬ সালে এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
রোববার দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ফল প্রকাশের ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এর আগে সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফলের সারসংক্ষেপ তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী। দুপুর ২টা থেকে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ও এসএমএসে এবং নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে ফল জেনেছে।
এবার পাসের হার কমলেও এ নিয়ে হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার ফলের সারসংক্ষেপ গ্রহণকালে এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার যেহেতু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, সংখ্যার হিসাবে পাসের হার কিছুটা কম মনে হলেও সেটা খুব হতাশাজনক নয়। কারণ ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ পাস করা, এটাও কিন্তু কম কথা নয়। তিনি কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান। পাশাপাশি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের হতাশ না হয়ে আরও বেশি উদ্যম নিয়ে আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন।
এসএসসিতে পাসের হার গত নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হলেও বিষয়টিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছি। মূল্যায়নে সমতা আনার জন্য এই পরিবর্তন। এই সমতা আনয়নের প্রভাব পড়তে পারে। সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উত্তরপত্র মূল্যায়নে উন্নতমান নিশ্চিত করা হয়েছে। আগে হয়তো শিক্ষকেরা ঠিকমতো মনোযোগ দিয়ে উত্তরপত্র দেখতেন না। এখন সেই সুযোগ কম। শিক্ষকরা যাতে ভালো করে খাতা দেখেন, ভালো করে দেখেই যেন নম্বর দেন, সমমানে মূল্যায়ন করেন- সেদিকে নজর দেয়া হয়েছে ও আগে থেকেই দিকনির্দেশনা ঠিক করে পরীক্ষকদের দেয়া হয়। এসবের প্রভাবে পাসের হার কমেছে। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিক্ষামন্ত্রীর পর্যবেক্ষণই সঠিক। গত বছরের তুলনায় পাসের হার হ্রাসের পেছনে আরও চারটি প্রধান কারণ আছে। এবার ১২টি বিষয়ের এমসিকিউ প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। ওই ফাঁস প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি দিক থেকে গলার ফাঁসে পরিণত হয়। একটি হচ্ছে, ফাঁস প্রশ্নের যে উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে সরবরাহ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ভুল ছিল। আরেকটি হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে শিক্ষার্থীরাও ঠিকভাবে পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারেনি। ফাঁসের কারণে ‘পরীক্ষা বাতিল হবে কি হবে না’- এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল অনেকে। এবার পরীক্ষার হলে নকল বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। ইংরেজি, গণিত এবং রসায়নে গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে। এসবও খারাপ ফলের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে চার বছর ধরে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) গবেষণা করছে। সেই গবেষণার ফল গত বছর থেকে প্রয়োগ করা হচ্ছে উত্তরপত্র মূল্যায়নে। গবেষণায় বেডু নম্বর প্রদানে বৈষম্য উদঘাটন করে। সেই আলোকে মডেল উত্তরপত্র দিয়ে বৈষম্য কমানো হয়েছে। সে আলোকে অন্য পরীক্ষকরাও নম্বর দিয়েছেন। ফলে সারা দেশে নম্বর প্রদান ও খাতা মূল্যায়নে একটি সমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ ছাড়া এমসিকিউতে তুলনামূলক কম পাসের ধারা এবারও অব্যাহত ছিল।
পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কুমিল্লা বাদে আর সব শিক্ষা বোর্ড। ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও আইসিটি- এই পাঁচটির বিষয়ভিত্তিক পাসের হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কুমিল্লা বোর্ড প্রত্যেকটিতে গত বছরের তুলনায় ভালো করেছে। এই বোর্ডে গত বছর ইংরেজিতে পাসের হার ছিল ৮৬ শতাংশ, এবার ৯১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গণিতে গত বছর ছিল ৮১ শতাংশ, এবার ৯০ দশমিক ১৬ শতাংশ। এভাবে এই বোর্ডে পদার্থবিজ্ঞানে গত বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ, রসায়নে ৪ শতাংশ পাসের হার বেশি। সে কারণে এই বোর্ডে গত বছরের চেয়ে ২১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। বিপরীত দিকে অন্য ৯টি বোর্ডে এই প্রত্যেক বিষয়ে পাসের হার কম। যে কারণে বোর্ডগুলোর সার্বিক পাসের হারও কমেছে। যেমন : ৯টি বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাসের হার কমেছে সিলেট বোর্ডে, ১০ শতাংশের বেশি। ওই বোর্ডে গত বছরের তুলনায় এবার ইংরেজিতে ৫ শতাংশ, গণিতে ১৬ শতাংশ, আইসিটিতে আড়াই শতাংশ পাসের হার কম।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখনও গণিত ও ইংরেজিতে অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা গণিতে ভালো হলেও ইংরেজিতে খারাপ করেছে। রসায়নেও এবার পাসের হার গত বছরের তুলনায় কম। বিজনেস স্টাডিজ ও মানবিকের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি-গণিত দুটিতেই খারাপ করেছে। তিনি আরও বলেন, এ বছরও উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উদারনীতির পরিবর্তে কঠোর এবং পরিকল্পিত পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। নতুন পদ্ধতি অনুসরণের জন্য পরীক্ষকদের নম্বর প্রদান নির্দেশিকা এবং মডেল-উত্তর দেয়া হয়। মডেল অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। পাশাপাশি তিন ক্যাটাগরির পরীক্ষার্থীর বিষয় (ভালো, মধ্যম ও দুর্বল) সামনে রেখে মডেল উত্তর তৈরি করা হয়। শুধু তাই নয়, উত্তরপত্র বণ্টনের সময়ে পরীক্ষকদের উদ্দেশে প্রধান পরীক্ষক এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। প্রধান পরীক্ষক আগে ১০ শতাংশ খাতা মূল্যায়ন করতেন। কিন্তু এ বিধান আসলেই প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা, তা দেখা হতো না। এবারও প্রধান পরীক্ষকদের জন্য ১২ শতাংশ খাতা দেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি তারা কোন কোন খাতা দেখেছেন, সে ব্যাপারে ছয় পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়েছে। এসব উদ্যোগের সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে ফলের ওপর।
এদিকে মাদ্রাসায় এবার পাসের হার কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। ওই বোর্ডের শিক্ষার্থীরাও গণিতে খারাপ করেছে। পাশাপাশি আরবি বিষয়েও খারাপ করায় পাসের হার কমেছে বলে মনে করেন বোর্ডটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফউল্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, জিপিএ-৫ বেড়েছে, এ নিয়ে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। বরং যারা ফেল করেছে তাদের দিকে নজর দেয়া দরকার। পাসের হার কমে গিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধি কোনো ভালো চিত্র নয়। কারণ আমি দেখেছি, যারা জিপিএ-৫ পেয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই কোনোমতে পাস করে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। আরেকটা দিক হল, যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের বেশির ভাগই শহরের। কারণ তাদের এই কোচিং-প্রাইভেটের মাধ্যমে সেভাবে তৈরি করা হয়েছে। শহরের স্কুলগুলোতে সুযোগ-সুবিধাও বেশি। তাই তারা ভালো ফলাফল করছে। যার বিপরীত চিত্র রয়েছে গ্রামে। সেখানে সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যে শিক্ষার্থীরা পাস করে আসছে, সেটাইতো অনেক বড় ব্যাপার। এ কথা মনে রাখতে হবে, একটি গ্রামের ছেলের সঙ্গে শহরের ভালো স্কুলের ছেলের মধ্যে মেধার কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো কেবলই সুযোগ-সুবিধার।
চার সূচকই নিম্নগামী : ভালো ফলের সূচক হিসেবে চারটি দিক ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে- পাসের হার, মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শতভাগ ও শূন্য পাস করানো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার সবক’টি সূচকই নিম্নমুখী।
মানবিক-বিজনেসে মন্দা, বিজ্ঞানে ভালো : সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞান বিভাগে এবার শিক্ষার্থী এবং পাসের হার বেশি। এবার এসএসসির ৮ শিক্ষা বোর্ডে বিজ্ঞানে পাস করেছে ৯৩ দশমিক ০৭ শতাংশ । বিজনেস স্টাডিজে ৮০ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং মানবিকে ৬৯ শতাংশ। গত বছর বিজ্ঞানে পাস করেছিল ৯৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিজনেস স্টাডিজে ছিল ৮০ দশমিক ২১ শতাংশ এবং মানবিকে ৭৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।যুগ