ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ডা. মোহাম্মদ শরীফ ১৯৯১ সালে যোগদান করেন। চাকরি জীবনের ২৭ বছর পার করেও তিনি একই পদে আছেন। অধিদপ্তরে ডা. শরীফ যে পদটিতে যোগদান করেছিলেন, সেটি নন-ক্যাডার। ২০২১ সালে তিনি অবসরে যাবেন। পদোন্নতি জটিলতা নিরসন না হলে তিনি যে পদে চাকরি শুরু করেছিলেন, সেই একই পদে থেকে তাকে অবসরে যেতে হবে।
ডা. শরীফের মতো পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আরও প্রায় এক হাজার ৭০০ কর্মকর্তা এভাবেই বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। কর্মজীবনে তারা যে পদে যোগদান করেছিলেন, অনেকে সেই পদ থেকেই অবসরে চলে গেছেন। আবার কেউ অবসর বয়ঃসীমার কাছাকাছি চলে এসেছেন। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। তবে এসব কর্মকর্তার পদোন্নতিবঞ্চিত থাকার পেছনে সরকার বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দায়ী নয়। খোদ কর্মকর্তারাই পদোন্নতিবঞ্চিত থাকার জন্য দায়ী! পদোন্নতি ঠেকাতে তিনটি গ্রুপের কর্মকর্তারা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছেন। মূলত এসব মামলার কারণেই বছরের পর বছর ধরে তাদের পদোন্নতি হচ্ছে না। পদোন্নতি না হওয়ায় প্রায় ৬০০ চিকিৎসক এরই মধ্যে চাকরি ছেড়েছেন। এ ছাড়া আরও প্রায় ২৩০ কর্মকর্তা আগামী দুই বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন। এ সময়ের মধ্যে নিজেদের করা মামলা নিষ্পত্তি না হলে শূন্য পদ পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারের মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস কার্যক্রম, পুষ্টিসেবা, ইমপ্ল্যান্ট, অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ প্রোগ্রামসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে। মাঠ পর্যায়ে চলমান কর্মসূচি হোঁচট খেতে পারে। এতে করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালকের (মা ও শিশু) দায়িত্বে থাকা ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, তার সঙ্গে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকরা বর্তমানে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবেই রয়ে গেছেন। তার মতো আরও তিন চিকিৎসক অধিদপ্তরে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সবাই মেডিকেল অফিসার। পদোন্নতি জটিলতার নিরসন না হলে মেডিকেল অফিসার হিসেবেই তাদের অবসরে যেতে হবে। পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। এতে করে মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়নে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ জটিলতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, কর্মকর্তারা নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। এতে করে নিজেদের পাশাপাশি জনগণের স্বার্থে গৃহীত কর্মসূচিরও সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। সরকারেরও এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব ফয়েজ আহম্মেদ সমকালকে বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কিংবা সিনিয়র স্কেল না পাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা নিজেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করে রাখার কারণে মন্ত্রণালয় চাইলেও কিছু করতে পারছে না। তারা ঐকমত্যে পৌঁছে মামলা তুলে নিলে কিংবা মামলা নিষ্পত্তি হলেও এ বাধা কেটে যাবে। নিজেদের স্বার্থেই তাদের মামলা কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, সে বিষয়ে চিন্তা করা উচিত বলে মনে করেন সচিব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে তিন শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১২শ’ মেডিকেল অফিসার। তারা প্রথম শ্রেণি এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আছেন ৪৮০ জন। তাদের মধ্যে ২২১ জন ক্যাডার সিডিউলভুক্ত আর বাকিরা নন-ক্যাডার সিডিউলভুক্ত। বছরের পর বছর পদোন্নতি না পাওয়ার কারণে প্রায় ৬০০ মেডিকেল অফিসার অধিদপ্তর থেকে চাকরি ছেড়েছেন। এ ছাড়া আরও ২৩০ কর্মকর্তা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন। বর্তমানে সেখানে কর্মকর্তার ১১০টি পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু মামলা থাকার কারণে ওইসব শূন্য পদে সরকার নিয়োগ দিতে পারছে না।
যে কারণে মামলা :অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদটি ১৯৮৫ সালে ক্যাডারভুক্ত হয়। এর আগে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির পদ ছিল। ক্যাডারভুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে শূন্য পদে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু তারা নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রেষণে চিকিৎসকরা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কাজ করতেন। কিন্তু পদোন্নতি না হওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসকরা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে প্রেষণে কাজ করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। পরে সরকার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ১৯৯১ সাল থেকে মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ প্রদান শুরু করেন। কয়েক বছর পর ১৯৯৯ সালে সরকারি কর্মকমিশন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদটি ক্যাডার সিডিউলভুক্ত করেন। এর পর ১৮তম বিসিএস থেকে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮ থেকে ৩৫তম বিসিএস থেকে পর্যায়ক্রমে ২২১ জন চিকিৎসক এ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৩০ জন সিনিয়র স্কেলের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদটি ক্যাডারভুক্ত হওয়ার পর নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি সংকুচিত হয়ে পড়ে। নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য তারা মামলা করলে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে, শূন্য পদে তাদের বাইরে যাতে অন্যরা পদোন্নতি না পায় সে জন্য ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারাও একটি মামলা করেন। সমঝোতায় না পৌঁছে তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। অথচ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ৪৮০ পদের মধ্যে ২৩০টি ক্যাডার সিডিউলভুক্ত। বাকি ২৫০ পদ ক্যাডার সিডিউলবহির্ভূত। এই ক্যাডার সিডিউলভুক্ত পদের বিপরীতে ২২০ জন এবং সিডিউলবহির্ভূত পদে ১১০ জন কর্মরত আছেন। অবশিষ্ট ১১০টি পদ শূন্য রয়েছে। একই সঙ্গে নন-ক্যাডার মেডিকেল অফিসাররাও তাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না করে অন্যদের পদোন্নতি বন্ধে আরেকটি মামলা করেন। কোনো মামলাই আজও নিষ্পত্তি হয়নি। মূলত তিন পক্ষের পরস্পরবিরোধী এই মামলার কারণে কোনো পক্ষই পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ সুযোগে অধিদপ্তরের আওতায় থাকা পরিচালকের ১২টি নন-ক্লিনিক পদে যুগ্ম সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন।
এখনও দ্বন্দ্বে কর্মকর্তারা :ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৭ জুলাই বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পরিবার পরিকল্পনা) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। প্রধানমন্ত্রী তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে সচিব ও মহাপরিচালকের সঙ্গে তৎকালীন জনপ্রশাসন উপদেষ্টাকে আলোচনা করারও নির্দেশনা দেন। তবে দীর্ঘ পাঁচ বছরেও সংকটের সমাধান হয়নি। উল্টো পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হানিফুর রহমান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের মধ্যে চাকরির বয়স অনুযায়ী, নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠ। তাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেলে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মর্যাদার সঙ্গে চাকরি করা সম্ভব হবে না। বিষয়টি নিয়ে তারা প্রথমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়ায় তারা আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত তাদের পক্ষে রায় দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ক্যাডার কর্মকর্তারা তার বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। পরে তা স্থগিত হয়ে যায়। এর পর ক্যাডার কর্মকর্তারা আরেকটি মামলা করলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। ক্যাডার কর্মকর্তারা ছাড় না দেওয়ার কারণে বিষয়টি নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
তবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোজাম্মেল হকবলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য একাধিকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু মেডিকেল অফিসাররা আগে তাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতা দাবি করেছেন। এটি মেনে নিলে বিসিএস করা ক্যাডার কর্মকর্তারা তাদের জুনিয়র হয়ে যাবেন। এটি ক্যাডার কর্মকর্তারা মানতে চান না। তারা এ বিষয়টি ছাড় দিলে যে কোনো সমঝোতার জন্য প্রস্তুত আছি।
যেভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কর্মসূচি :সংশ্নিষ্ট অধিপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী, একজন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাঠ পর্যায় থেকে কাজ করে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক এবং পরিচালক পদে আসীন হবেন। এই পদ্ধতিতে পদোন্নতি পেয়ে কেউ দায়িত্ব পালন করলে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি আরও সফল হতো। কিন্তু মামলার কারণে সে পথও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি মামলার কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরাসরি ওই পদে কোনো কর্মকর্তাকে পদায়নও করতে পারছেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করে সেখান থেকে সংযুক্তি হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদে পদায়ন করা হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তাকে সংযুক্তি পদায়ন করা হয়, তারা পরিবার পরিকল্পনার টার্মগুলো বুঝে ওঠার আগেই অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। পরে যাকে পদায়ন করা হয়, তিনিও বেশিদিন থাকেন না। এতে করে মাঠ পর্যায়ে কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার সমকালকে বলেন, কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে তিনি তিন গ্রুপের সঙ্গেই আলোচনা করেছেন। এমনকি তাদের নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তারা মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু মেডিকেল অফিসারদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি এবং নন-ক্যাডারদের জ্যেষ্ঠতা নিয়ে আবারও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে- পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় চলমান জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির কথা বিবেচনা করে সব পক্ষই ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে এসে সমঝোতায় পৌঁছাবেন। সমকাল