ক্রাইমবার্তা রিপোট : দশম জাতীয় সংসদের প্রথম চার বছরে অর্থাৎ ১৮তম অধিবেশন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩০ মিনিট কোরাম সংকট হয়েছে। সংসদ অধিবেশন চলাকালীন ১২ শতাংশ সময় অর্থাৎ ১৫২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট কোরাম সংকটের অর্থমূল্য ১২৫ কোটি টাকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দশম জাতীয় সংসদের ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বর্তমান বিরোধী দল আত্মপরিচয় সংকটে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন উত্থাপনকালে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান সংসদ সুশাসন ও সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলেরও দায় রয়েছে। আইন প্রণয়নে এমপিদের আগ্রহ কম।
তিনি আরও বলেন, বিরোধী দল হিসেবে যাদের উপস্থাপন করা হয়েছে, তাদের নিজেদের আত্মপরিচয়ের সংকট সংসদের শেষ দিকে এসে একাধিকবার তাদের নিজেদের মুখেই শোনা গেছে। যে কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। চলতি সংসদের ১৪তম থেকে ১৮তম অধিবেশন পর্যন্ত (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত অধিবেশন নিয়ে পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্স ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি।
টিআইবির গবেষণায় পাওয়া গেছে, সংসদ অধিবেশনের বিভিন্ন আলোচনা পর্বে সংসদ সদস্যরা অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করেছেন মোট সময়ের ৫ শতাংশ। সদস্যদের ভেতরের প্রতিপক্ষ দল সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে ১৯৫ বার অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করেছে। বিশ্বব্যাংক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার হয়েছে ২৩ বার। সরকার ও বিরোধী দলের নেতা ও সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করা হলেও এ ধরনের আলোচনা বন্ধে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি দেখা যায়। এই অবস্থায় সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
টিআইবি দেয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদের ১৪-১৮তম অধিবেশন পর্যন্ত মোট কার্যদিবস ছিল ৭৬টি। এ সময়ে ২৬০ ঘণ্টা ৮ মিনিট সংসদ চলেছে। প্রতিদিন গড়ে ৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট সংসদ চলেছে। এসব অধিবেশনে গড় উপস্থিতি ছিল ৩০৯ জন, যা মোট সংসদের ৮৮ শতাংশ। সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন হলেও এ কাজে অধিবেশনের মাত্র ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। এ সময়ে ২৪টি সরকারি বিল পাসে প্রতিটিতে গড়ে ‘মাত্র’ ৩৫ মিনিট সময় লেগেছে। সবচেয়ে বেশি ৬৬ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে।
প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এই সময়ে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলক বাড়লেও মন্ত্রীদের উপস্থিতি কমেছে। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উভয়ের উপস্থিতি বাড়লেও এমপিদের উপস্থিতি উল্লেখ্যযোগ্যভাবে কম ছিল। এ সময় সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের সংসদে দেয়া বক্তব্যে আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির উল্লেখসহ বাজেটে প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর গঠনমূলক আলোচনা ইতিবাচক। তবে অব্যাহত ছিল অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার। সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। আর স্পিকার অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত সংসদে চারটি কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে নেয়া হলেও এবার শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে নেয়া হয়েছে। সংসদের নারী সদস্যদের উপস্থিতি বাড়লেও সংসদীয় কার্যক্রমে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়, আইন প্রণয়নে জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাবের আলোচনার তুলনামূলকভাবে বিরোধী দল বেশি অংশ নিলেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি সংসদে বিরোধী দল নিজেদের ভূমিকা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে তাদের দলীয় আত্মপরিচয় বা অবস্থান সংকটের প্রতিফলন ঘটেছে।
এক্ষেত্রে প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংসদের সংশোধিত বাজেটের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও বিভিন্ন ভাতা, সম্পদ ও অবকাঠামো মেরামত ও সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে কোরামের টাকার হিসাব করা হয়েছে। এই চারটি অধিবেশনে প্রতিদিন গড় কোরাম সংকট ছিল ৩০ মিনিট। এই চার অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৮ টাকা।
কোরাম সংকটকে উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোরাম সংকটের অর্থমূল্যের বিষয়টি প্রাক্কলিত আনুমানিক অর্থমূল্য। এটাকে টিআইবি দুর্নীতি বা অপচয় বলছে না। একটি ধারণা দেয়ার জন্য এই অর্থমূল্যের প্রাক্কলন করা হয়েছে। তকে এটা সংসদ সদস্যদের সংসদীয় কার্যক্রমে ঘাটতির পরিচয়। কোরাম সংকট যাতে না হয় সেদিকে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সংসদে আইন পাসের সময় কম হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একটি বিল পাস হতে গড়ে ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সময় লাগলেও আমাদের লাগে গড়ে ৩৫ মিনিট। ফলে এমপিদের সংসদের সার্বিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে যে ঘাটতি রয়েছে, আইন প্রণয়নে তা আরও বেশি। সরকারদলীয় সদস্যদের ক্ষেত্রে সেই উৎসাহটা আরও কম বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো চুক্তি সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলো সংসদে উত্থাপন বা জনগণের জানানোর কোনো উদ্যোগ নেই। নব্বই-পরবর্তী সময়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটা ভালো চলছে না বলেও তিনি দাবি করেন।