ক্রাইমবার্তা রিপোট জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে (ইউপিআর) মৃত্যুদণ্ড বিলোপ, সমকামিতার বৈধতাসহ বিভিন্ন দেশের ৬১ সুপারিশ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।
একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। এছাড়া স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোসহ বিভিন্ন দেশের ১৬৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
এছাড়া আরও ২৩টি সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশ পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবে। ইউপিআর-এ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে বৃহস্পতিবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের অধিবেশনে একটি খসড়া প্রতিবেদন গৃহীত হয়।
ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিভিন্ন দেশের ২৫১টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। অধিবেশনে বাংলাদেশ যে ২৩টি সুপারিশের বিষয়ে জানায়নি এগুলো আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৯তম অধিবেশনের মধ্যেই জানাতে হবে।
বাংলাদেশ ছাড়াও বৃহস্পতিবার রাশিয়া ও আজারবাইজানের ইউপিআর বিষয়ক প্রতিবেদন গৃহীত হয়েছে।
সোমবার জেনেভায় ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল যোগ দেয়। আইনমন্ত্রী বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিষয়ে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয় তুলে ধরেন। তিনি খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর উদ্বেগের জবাব দেন। এসব ইস্যুতে তিনি বর্তমান সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
বৈঠকে মানবাধিকার পর্যালোচনায় বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে। উরুগুয়ে, মন্টেনিগ্রো, আইসল্যান্ড, টোগো ও স্পেন মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুপারিশ করে। বাংলাদেশ এই সুপারিশ নাকচ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে গুম হচ্ছে এমন বিষয় উল্লেখ করে জাপান, বসনিয়া, ইরাক, সেনেগাল, টোগো, ইউক্রেন, পেরু উদ্বেগ প্রকাশ করে। গুম থেকে নাগরিকদের সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করতে দেশগুলো বাংলাদেশকে সুপারিশ করে।
এই সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশ সরাসরি না করে দেয়। শিশুশ্রম বন্ধে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৩৮ ও ১৩৯ নম্বর সনদ অনুমোদনের বিষয়ে বাংলাদেশকে স্পেন ও মাদাগাস্কার সুপারিশ করে। এই সুপারিশও বাংলাদেশ আমলে নেয়নি। বৈঠকে সমকামিদের বৈধতা দিতে ব্রাজিল সুপারিশ করলে তা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ।
এছাড়া বাংলাদেশ আরও যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হয়নি সেগুলো হল- নির্যাতনবিরোধী সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকলে স্বাক্ষর, ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদ অনুমোদন, নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডও) বিভিন্ন ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার, বৈদেশিক অনুদান আইন সংশোধন, রাষ্ট্রহীন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার, জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সফরের অনুমতি প্রদান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এমন সব বিধান বাতিল করা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে রক্ষায় নীতি গ্রহণ।
এদিকে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে নরওয়ে ও সুইডেন সুপারিশ করে নতুন করে পর্যালোচনা এবং খসড়া করে যেন এটি প্রণয়ন করা হয়। এক্ষেত্রে অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন ক্ষুণ্ণ না হয় এ বিষয়টি বাংলাদেশকে নিশ্চিত করার সুপারিশ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো অঙ্গীকার করেনি। এই সুপারিশ পর্যালোচনা করে জানানো হবে। যুক্তরাজ্য ও উত্তর আয়ারল্যান্ড সুপারিশ করে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের জোরপূর্বক কাজ করানো এবং মানবাপাচারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে পরিদর্শন বাড়াতে হবে।
এই বিষয়েও বাংলাদেশ পরবর্তীতে জানাবে বলেছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ আরও ২১টি সুপারিশের বিষয়ে কিছু জানায়নি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে তা সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাবে।
মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনাসহ ১৬৭ সুপারিশ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার : ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের বিষয়ে আলোচনা হয়। তাদের মানবাধিকারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে।
তবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় বদ্ধপরিকর। নিউজিল্যান্ড, জাপান, আজারবাইজান ও ইয়েমেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে সুপারিশ করে। রোহিঙ্গাদের কীভাবে তাদের ইচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায় এ বিষয়ে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
আজারবাইজান সুপারিশ করে এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। জাপান সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে এগুলো বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
বৈঠকে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি অভিবাসীদের মানবাধিকারের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে অনেক দেশ। স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ধর্ষণের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে বৈঠকে সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
ইউপিআর পর্যালোচনায় র্যার্পোর্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করে রুয়ান্ডা, আফগানিস্তান ও ইউক্রেন। ইউপিআর ওয়ার্কিং গ্রুপের মাধ্যমে ৭ মে থেকে ১৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৪টি রাষ্ট্রের পর্যালোচনা করা হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ও ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের ইউপিআর পর্যালোচনা করা হয়েছিল।