সিন্ডিকেটের কবলে জেলা খাদ্য বিভাগ *কৃষকের কাছ থেকে না কিনে কিনছে মিলারদের চাল

ক্রাইমবার্তা রিপোট”  জেলায় বোরো ধান কাটার শেষে বাজারে ধানের দাম না পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক চাষীরা। চলতি বছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। সমিতি (এনজিও), সারের দোকানের বাকী টাকা, এমনকি শ্রমিকের মজুরী দিতে পারছে না এসব কৃষকে। গত কয়েক দিন যাবত বাজারে ধানের অস্বাভাবিক দাম কমের কারণ হিসেবে সরকার ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয় না করাকে দায়ি করেছেন জেলার অধিকাংশ কৃষক। তাদের দাবি, সরকারের ঘোষণার ১৮ দিন অতিবাহিত হলেও কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মূল্যে ধান না কেনায় জেলায় কৃষকরা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছর সদর উপজেলায় ২৩ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ করা হয়েছে এবং কলারোয়া উপজেলায় বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে প্রান্তিক কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয়ে সরকার কেজি প্রতি ২৬ টাকা ও মিলারদের নিকট থেকে চাল ক্রয়ে ৩২ টাকা নির্ধারণ করেন। ধান ক্রয় কার্যক্রম ২ মে থেকে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের ১৮ দিন অতিবাহিত হলেও জেলায় কৃষকের ধান ক্রয় কার্যক্রম শুরু হয়নি। জেলা খাদ্য অফিস থেকে বলা হচ্ছে সরকারের নিকট থেকে ধান ক্রয়ের কোন চিঠিপত্র আমাদের হাতে আসেনি। অথচ সিন্টিকেটের মাধ্যমে মিলারদের কাছ থেকে চাল ক্রয় শুরু হয়েছে। ফলে বাজারে ধানের দাম অস্বভাবিক কমেছে। চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২শত টাকা, মোটা ধান নেওয়ার কোন ক্রেতায় নেই। মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে ৯শত থেকে হাজার টাকা। এতে করে প্রান্তিক কৃষকদের মাথায় হাত উঠেছে। আর এ সুযোগে সিন্ডিকেট তৈরী করে বাজার থেকে অল্প দামে ধান কিনে মিলারদের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত ৩২ টাকা দরে চাল সরবরাহের জন্য খাদ্য গুদাম কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে। প্রতিটি চালের ট্রাকে ৮ থেকে ১০ হাজার ঘুষ নিয়ে খাদ্য গুদামে চাল ঢুকাচ্ছে।
সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা এলাকার প্রান্তি চাষী সুবির ঘোষ, নজরুল ইসলাম, আকবার আলীসহ একাধিক কৃষকরা জানায়, সরকার নির্ধারিত এক মণ (৪০ কেজি) ধানের মূল্য ১০৪০ টাকা। বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে। প্রতিমণ ধানে কৃষকের ৩৫০/৩৬০ টাকা লোকসান হচ্ছে। তারা আরো জানায়, এই সুযোগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অল্প দামে ধান কিনে মিলারদের মাধ্যমে ৩২ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা শুরু করেছে। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে চাল সরবরাহ করে প্রতিকেজি চালে ১০/১১ টাকা লাভবান হচ্ছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল বিক্রি করে এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও প্রকৃত কৃষকরায় মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের মিজানুর রহমান সানা, জাকির হোসেনসহ কয়েকজন কৃষক জানান, বাজারে ধানের দাম ১৬/১৭ টাকা কেজি (মণ ৬৫০-৭০০টাকা) দরে বিক্রি হচ্ছে। উপজেলায় গত ২০/২৫ বছরের মধ্যে বোরো ধানে কৃষকদের এধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়নি। মিজানুর রহমান আরো বলেন, আগামীতে অধিকাংশ কৃষক ধানের আবাদ করবে না কারণ এই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদের সময় লাগবে।
কৃষক সাইদুর রহমান জানান, ধান উৎপাদনের খরচ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে বাড়ছে না উৎপাদিত ফলানো ধান। এলাকার কৃষকরা অধিকাংশ গরিব। তারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করে সংসার চালায়। ধান উঠানোর সাথে সাথেই তা বিক্রি করে ধার-দেনা শোধ করতে হয়। এবছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় সব কৃষকের মুখে হাসি ফুটলেও সময়মত সঠিক দাম না পাওয়ায় সেই হাসি অন্ধকারে পরিণত হয়েছে। কারণ এই ধান বিক্রি করে দোকান থেকে নেয়া সার, বীজ, কীটনাশক, মাঠের পানিসহ সব কিছুর দাম পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নিজেদের বছরের খোরাক তো রয়েছে। তারা ধানের সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, প্রতি বছর সিন্ডিকেট করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেবে আর আমরা কষ্টকরে ফলানো ধানের নায্য মূল্য পাবো না বরং দেনার পরিমান বৃদ্ধি পাবে। সাইদ গাজী নামে এক কৃষক জানান, তিনি ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বোরো ধানের চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৯ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ধান হয়েছে ১৬ থেকে ১৮ মণ, বর্তমানে মণ প্রতি ধানের দাম সাড়ে ৬৫০ থেকে ৬৭০ টাকা। তিনি বলেন, এ টাকায় ধান বিক্রি করে আমি শুধু শ্রমিকের মজুরী দিতে পেরেছি। বাকি কিছু টাকা আছে। এই দিয়ে সার, ডিজেলের দোকানে অল্প কিছু দেনা দিতে পারবো। তিনি আপেক্ষ করে বলেন, সভার ভাগ্যের উন্নয়ন হয় কৃষদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন হয়না।
এবিষয়ে সাতক্ষীরা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) মো. আরশাফুজ্জামান জানান, ধান ও চালের দাম নির্ধারণসহ তারিখ উল্লেখ করে অধিদপ্তর থেকে জানানো হলেও আমাদের কাছে সরকারের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের জন্য কোন চিঠি দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা যোগাযোগ করছি কিন্তু ধান ক্রয়ের বিষয়ে কোন নির্দেশনা পাচ্ছি না। তিনিও বলেন, জেলার কৃষকরা এবছর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে মিলারদের নিকট থেকে চাল ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মিলারদের কাছ থেকে চাল নেওয়া হচ্ছে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।