আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরাঃ : বাংলাদেশের ‘হোয়াইট গোল্ড এলাকা’সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করেছে। এ অঞ্চলের চাষীদের মুখে ফিরেছে হাসি। প্রতিবছর জেলাতে কাঁকড়ার আবাদ ও বাড়ছে। চিংড়িতে ভাইরাস,রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়াতে চিংড়ি চাষীরা কাঁকড়া চাষে ঝুকছে। আন্তজার্তিক বাজারের কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সাতক্ষীরায় সরকার পরিকল্পিত ভাবে কাঁকড়া শিল্প গড়ে তুলেছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সাতক্ষীরাতে এ শিল্পটি চাষীদের মাঝে ব্যাপক আস্থা অর্জন করেছে। চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়াতে লাভ বেশি হওয়ায় চাষীরা বাণিজ্যিক ভাবে কাঁকড়ার চাষ শুরু করেছে। এমনকি বেকার যুবক- যুবুকেরা সরকারী ভাবে কাঁকড়া চাষের উপর ফ্রি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বল্প পুজি বিনিয়োগ করে কাঁকড়া চাষে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১১২টি সরকারি ও ৩৪০টি বেসরকারি কাকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। আরও কয়েকটি খামার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ মৌসুমে জেলাতে কাঁকড়ার চাষ হয়েছে ৮৪.২ হেক্টর জমিতে,২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৩.৮৭ হেক্টর জমিতে, ২০১৪ -১৫ অর্থ বছরে ৫৩.৩৯ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার চাষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, জেলায় ২০১৩ সালে দুই হাজার তিনশ’ মেট্রিক টন, ২০১৪ সালে দুই হাজার চারশ’ মেট্রিক টন ২০১৫ সালে দুই হাজার আটশ’ ১৪ মেট্রিক টন , ২০১৬ সালে তিন হাজার মেট্রিক টন ,২০১৭ সালে তিন হাজার চারশ মেট্রিক টন কাকড়া উৎপাদন হয়। যার প্রায় সবটাই রপ্তানিযোগ্য। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জে ও শ্যামনগরে ।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলাতে মোট ৪৫২টি কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। প্রতি বছর এসব ঘেরে সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪-১৫ সালে জেলাতে কাঁকড়ার ঘের ছিল ৩৬৪টি, ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৩৮০টিতে এবং ২০১৬-১৭ সালে এসে তা দাড়ায় ৪৫২টিতে। এভাবে অব্যাহত রয়েছে কাঁকড়া ঘেরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে।
অনেক আগেই কাঁকড়া চাষ শুরু হলেও এখন এটি দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। ধর্মীয় কারণে দেশে তেমন একটা চাহিদা না থাকলেও বিদেশে কাঁকড়ার চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। রপ্তানি তালিকায় অপ্রচলিত এই ‘পণ্য’ই বদলে দিচ্ছে লাখো মানুষের ভাগ্য। যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত গলদা চিংড়িকে অদূর ভবিষ্যতে হার মানাতে পারে এই জলজ সম্পদ। সাতক্ষীরাতে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার।
কাঁকড়া চাষীর সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যাক্তির কাছ থেকে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে যে পরিমান কাঁকড়া ধরা পড়ে তা প্রাকৃতিকভাবে রেনু থেকে বড় হয়। এ অঞ্চলের ১২ মাস লবনাক্ত পানি কাঁকড়া চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। তাছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য প্রচুর জমি ও অর্থের প্রয়োজন হলেও কাঁকড়া চাষের জন্য জমি ও অর্থ দুটোই কম লাগে। যে কারণে চাষীরা কাঁকড়া চাষে ঝুকে পড়ছে।
চাষীরা জানালেন, বাজার থেকে কাকড়া কিনে ছোট ছোট খাচায় রেখে মোটাতাজা করা হচ্ছে। ২০ থেকে ২২ দিনেই একবার খোলস পরিবর্তন করে প্রতিটি কাঁকড়া। এতে প্রতিটি কাকড়ার ওজন বেড়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়। পরে এই কাকড়া রপ্তানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এতে লাভ বেশি ও রোগবালাই কম হওয়ায় সাতক্ষীরায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে খাচায় কাকড়া পদ্ধতি।
জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের কলবাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন খাস জমিতে বিশেষ এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অর্থায়নে ইনোভেশন ইন পাবলিক সার্ভিসের আওতায় শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন গড়ে তুলেছে কাকড়া মোটাতাজাকরণ খামার। দুই বিঘা জমির এই খামারে সাড়ে পাঁচ হাজার খাচায় কাকড়া মোটাতাজা করা হচ্ছে। যার ব্যবস্থাপনায় রয়েছে স্থানীয় বাগদী সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
চাষীরা জানালেন,খাঁচায় কাঁকড়া চাষের কথা। তারা জানান, খাচায় চাষকৃত কাকড়ার খোলস নরম থাকে। এ কারণে বাজার চাহিদাও বেশি। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত এসব কাঁকড়া প্যাকেটজাত করে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র্র, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। দামও পাওয়া যায় ভালো, কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। শুধু বাগদী সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, চিংড়ি চাষের তুলনায় লাভ ও ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা না থাকায় অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন কাকড়া চাষে। যার ফলশ্রতিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যে জেলায় ৪৫২টি কাকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। আর এ খাত থেকে ক্রমেই বাড়ছে রপ্তানি আয়।
একশত খাঁচা নিয়ে কাঁকড়ার চাষ শুরু করেন দেবহাটার বদরতলা এলাকার একজন কাঁকড়া চাষী মানিক চন্দ্র বাছাড়। বর্তমানে তার ঘেরে ১৫শ খাঁচা কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। ২২ শতক জমিতে সে কাঁকড়া চাষ করছে। তিনি জানান,চিংড়ির চেষে কাঁকড়া চাষে খরচ কম লাভ বেশি। তাই সে চিংড়ির পরিবর্তে খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করেন। এবছর সে কাঁকড়া বিক্রি করে লক্ষাধীক টাকা লাভ ও করেছে। তিনি জানালেন এল্লারচর মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কাঁকড়া চাষে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি কাঁকড়া চাষ করছেণ।
সরকার কাঁকড়া চাষীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ ও মুলধন দিচ্ছে। জানালেন,মনিকা রাণি। যিনি বর্তমানে একজন উদ্যোক্তা। দেবহাটার নোড়ারচক এলাকার কানাই লাল মন্ডলের স্ত্রী। তিনি স্থানীয় মহিলা সমিতির সভানেত্রী। তার নের্তত্বে ৫৫ জন মহিলা পুকুরে খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করে। সরকার তাদেরকে ১৫০টি খাঁচা দিয়েছে । সরকারী ভাবে এ উদ্যোক্তা কাঁকড়া চাষে প্রশিক্ষণ নিয়ে মহিলাদের মাঝে কাঁকড়া চাষের অভিজ্ঞগাতা বিনিময় করেন। এতে তার দল কাঁকড়া চাষে সুফল দেখছে। সে খুব আনন্দিত। এবার নতুন ভাবে কাঁকড়া চাষে সফলতা পাবে আশা তার।
চাষীরা বলেন, প্রতিদিন বাজার থেকে ছোট সাইজের কাকড়া কিনে খাচায় রেখে মোটাতাজা করা হয়। খাঁচায় কাঁকড়া খাবার হিসেবে তারা প্রতিদন ছোট ছোট একটি করে তেলাপিয়া মাছ খাচায় দেন। যা বাজার থেকে সস্তায় কেনা হয়। কয়েকদিনের মধ্যে খোলস পরিবর্তন করলেই কাক্সিক্ষত ওজন বেড়ে যায় কাঁকড়ার। শ্যামনগরের কাকড়া চাষি বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল জানান, মোটাতাজা করার জন্য প্রয়োজনীয় কাকড়া জোগান দেওয়া সম্ভব হলে রপ্তানি খাতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে পারে। কিন্তু যতই মোটাতাজাকরণের খামার বাড়ছে ততই ছোট কাকড়ার প্রাপ্যতা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে।
এল্লারচর মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: নাজমুল হুদা জানালেন, কাঁকড়া চাষীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সরকারী খরচে প্রতি দিন কাঁকড়া চাষীদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সম্ভবনাময় এখাতকে এগিয়ে তিতে সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম সরদার জানালেন, লাভ বেশি হওয়ায় জেলায় কাকড়া চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মোট রপ্তানির একটি বড় অংশ সাতক্ষীরা থেকে যায়। এছাড়া রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য সরকার এই খাতকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনয়ি পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়ে যাচ্ছে।————–আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা: ২৪/০৫/১৮