স্টাফ রিপোর্টার : আজ ২৫ মে, ১১ জৈষ্ঠ, শুক্রবার। সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯ তম জন্মবাষির্কী। জাতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসায় দিনটি উদযাপন করবে। কবি নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন। তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। মুলত বিদ্রোহী হলেও নজরুল ছিলেন চির তারুণ্য ও প্রেমের কবি। তার মধ্যে একই সঙ্গে দ্রোহ ও প্রেমের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।
জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান জাতির উদ্দেশে পৃথক বাণী দিয়েছেন। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হবে কবিকে নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও এফএম রেডিও স্টেশনগুলোতে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠান মালা ।
সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, বাংলা সাহিত্য গগণে নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। তার সৃষ্টিসমাহার সকল যুগে, সকল জনপদে সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের নির্মাণ। অধিকাংশ গান সুরপ্রধান। বৈচিত্র্যপূর্ণ সুরের লহরী কাব্যকথাকে তরঙ্গায়িত করে এগিয়ে নিয়ে যায়।
নজরুল বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন যার প্রভাব তার লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তার কবিতা, গান ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
স্বাধীনতা লাভের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।
এ বছর জন্মজয়ন্তির মূল অনুষ্ঠান হবে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
অন্যদিকে কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এদিন সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। নজরুল ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এ উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
নজরুল ইন্সটিটিউট জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে এবং কাজী নজরুল ইসলামকে বর্তমান প্রজণে¥র সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে কবির ছবি, পোস্টার ও বই প্রদর্শনীর আয়োজন করবে।
এছাড়া জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে।
দৌলতপুরে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু আজ
মো. আবু ইউসুফ, মুরাদনগর (কুমিল্লা) থেকে : প্রতি বছরের মতো এবারো কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কবি নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত কবিতীর্থ দৌলতপুরে কবির ১১৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হচ্ছে আজ। এ উপলক্ষে গ্রামটিতে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ, শুরু হয়েছে ‘নজরুল গ্রামীণ মেলা’। প্রথম দিনের কর্মসূচি হিসেবে আজ ২৫মে (শুক্রবার) সকাল ১০টায় নজরুল মঞ্চে রয়েছে- ‘দৈৗলতপুরে নজরুল’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ১১টায় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পরিবেশনা।
আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ ছাড়াও ‘নজরুল ও নার্গিস : প্রেম ও বিচ্ছেদের উপাখ্যান’ শীর্ষক আলোচনা সভা। ১১টায় উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি ও নার্গিস-নজরুল শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এমপি। জেলা প্রশাসক মো: আবুল ফজল মীর-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুল কাইয়ূম খসরু। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিতু মরিয়ম।
কুমিল্লার কো¤পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে ৮ কি: মি: সামনে আসলেই কবিতীর্থ দৌলতপুর গ্রাম। এ গ্রামে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে ‘নজরুল তোরণ’। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরো টুকরো ব্লকে সাদা কালিতে লেখা কবির পঙ্ক্তিমালা। ওই পথ ধরে আধা কিলোমিটার ভিতরে গেলেই খাঁন বাড়ি। যে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে নজরুলময় হয়ে ওঠেন ভক্তরা। ওই বাড়ি আর গ্রাম দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে নজরুল-নার্গিসের গ্রাম হিসেবে। এখানে রয়েছে আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বি-তল বাড়ি। এ বাড়িতেই থাকতেন কবি নজরুল। দীর্ঘদিন ধরে কোন প্রকার সংস্কার না করায় বাড়িটির পলেস্তর খসে পড়ছে। এ ভবনের পেছনে বাঁশঝাড় পার হলেই কবির বাসর ঘর। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা করা হলেও আয়তন ও ভিটির কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ওই ঘরেই ছিল নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক। অযতœ ও অবহেলার কারণে সিন্দুকটি কোথায় আছে তা কেউ বলতে পারে না। এক সময় ওই ঘরে বাসর খাটটিও ছিল। সেটি পাশের একটি আধা পাকা ঘরে রাখা হয়েছে।
শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুপম লীলাভূমি কবিতীর্থ দৌলতপুর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যে নান্দনিক মাত্রা দিয়েছে। এখানেই ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’র ঝংকার বেজেছিল নার্গিসের সুপ্ত ভালোবাসার সংস্পর্শে। এখানেই নার্গিসের ভালোবাসার আগুনের পরশমানিকের ছোঁয়ায় বেজেছিল নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’। ১৯২১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গ্রামে আসেন। এখানকার সবুজ-শ্যামল পরিবেশ কবিকে দারুণভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। এখানে কবি রচনা করেছেন ১২০টি কবিতা অসংখ্য গান ও ছড়া। কিন্তু সেই দৌলতপুর আজও অবহেলিত ও উপেক্ষিত। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কবির নামে হয়নি কোন প্রতিষ্ঠান। এমনকি ১৭ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত ‘নার্গিস-নজরুল বিদ্যা নিকেতন’ আজো এমপিওভুক্ত হয়নি।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিতু মরিয়ম জানান, জাতীয় কবির স্মৃতি রক্ষার্থে দৌলতপুরে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। শুধু নজরুল জয়ন্তীতে নয়, সারা বছর ধরে যেন নজরুল চর্চা অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া নার্গিস-নজরুল বিদ্যা নিকেতনের বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নজরুল আমাদের জাতীয় চেতনার উৎস এবং জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে নজরুলের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়। দৌলতপুরবাসী নজরুলের সংস্পর্শে আসতে পেরে ধন্য। নজরুলের মানবতাবোধ, প্রেম এবং দ্রোহ বর্তমান অস্থির সময়ে জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। যদি আমরা সকলে নজরুল চর্চায় ব্রতী হই এবং নজরুল থেকে শিক্ষা নেই।
কুমিল্লার ৪নং বিচার আদালতের এ.পি.পি এডভোকেট এইচ.টি আহম্মেদ ফয়সাল জানান, কবি নজরুলের নামে দৌলতপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিসহ আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বি-তল বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে কবি পত্মী নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক ও বাসরখাটটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তিনি আরো জানান, প্রতিবছর এখানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাদামাটা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আমরা কবিতীর্থ দৌলতপুরকে রাষ্ট্রীয় ভাবে মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই।
কবিপতœী নার্গিস বংশের উত্তরসূরী বাবলু আলী খান জানান, এ বাড়ির পুকুর ঘাটের আম গাছ তলায় কবি দুপুরে শীতল পাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খান বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন। কবির ওই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে বানানো হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’।
নজরুল-নার্গিস স্মৃতি সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি হুমায়ূন কবীর খান জানান, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর গ্রামে কবির নামে অনেক কিছু হয়েছে। অথচ দৌলতপুরে কিছুই হলো না। কবি দুই মাস ১১ দিন ছিলেন। এখানে তিনি যৌবনে প্রেম ও বিয়ে করেছেন। অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। দৌলতপুরে কবির নামে বড় ধরনের স্থাপনা ও নজরুল চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।