আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা: চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় সাতক্ষীরায় চিংড়ি রেণুর ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। মৌসুমের শুরুতে চাহিদা মত রেণু না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চাষীরা। ফলে চিংড়িতে উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা অর্জনে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রতি দিন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চাষীরা চিংড়ি রেণু কিনতে ভীড় করছে সাতক্ষীরা শহরের রেণু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গুলোতে। ফলে জমজমাট হয়ে উঠেছে জেলার চিংড়ি রেণুর কেনা বেচা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলাতে ৩৪৪ কোটি ৫৫ লক্ষ চিংড়ি রেণুর চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে বাগদা ৩৩৪ কোটি এবং গলদা ১০ কোটি ৫৫ লক্ষ। এসব চাহিদার বিপরীতে সাতক্ষীরায় ১০টি হ্যাচারীতে ৮০ কোটি ৬ লক্ষ চিংড়ির রেণু উৎপাদানের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে। ফলে ২৬৪ কোটি ৪৯ লক্ষ রেণুর ঘাটতি মেটাতে হিমশীম খেতে হয় চিংড়ি চাষীদের।
চিংড়ি চাষী ও পোণা সরবরাহকারীরা জানান,এবর জেলাতে ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫৫০টি চিংড়ি রেণুর বক্স দরকার। চাষীদের মতে একটি বক্সে ২টি পলিতে ১০ থেকে ১২ হাজার চিংড়ি রেণু থাকে। বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা শহরের চিংড়ি রেণু বক্স প্রতি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার টাকা দরে। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে জেলাতে চিংড়ি রেণু বেচা কেনা হবে ১৩৭ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে জেলা থেকে সরবরাহ করা হবে ৮০ হাজার ৬০টি বক্স। যার বাজার মূল্য দাড়ায় ৩২ কোটি ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১০৫ কোটি ৭৯ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মূল্যে চিংড়ি রণেু জেলার বাইরে থেকে সরবরাহ করতে হবে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলাতে ৬৬ হাজার ৭৬০টি চিংড়ি ঘের রয়েছে । এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা ৫৫ হাজার ১২২টি ও গলদা চিংড়ি ঘের রয়েছে ১১ হাজার ৬৩৮টি।
চলতি মৌসুমে জেলাতে ৭৬ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষের লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাগদা ৬৬ হাজাার ৯১০ হেক্টর এবং গলদা ৯ হাজার ৩৯৮ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধরণ করা হয়েছে।
জেলাতে বাগদা চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে ৩৩৪ কোটি । যার হেক্টর প্রতি ৫০ হাজার পিএল মজুদের কথা বলা হয়েছে। যে খানে ৯টি হ্যাচারীতে উৎপাদিত নপ্লি নার্সিং করে ৮০ কোটি পিএল উৎপাদেেনর লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারী ভাবে জেলাতে মাত্র একটি গলদা চিংড়ির হ্যাচারী গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে মাত্র ৬ লক্ষ ৭ হাজার পিএল উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা ধরা হয়েছে।
ফলে মানসম্মত রেণু পোনার অভাবে সাতক্ষীরা অঞ্চলের মৎস্য চাষিরা কাক্সিক্ষতচিংড়ি উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু পোনা আহরণ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকার কারণে দূর থেকে আনা হ্যাচারির অপুষ্ট রেণু পোনা চাষ করে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন চাষিরা।
মৎস্য বিভাগ বলছে, সরকারিভাবে স্বাদু পানির রেণু উৎপাদনে জেলায় প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত মানসম্মত পোনা সরবরাহ করতে পারলে চিংড়ি চাষিদের সমস্যা সমাধান হবে।
মানা হচ্ছে না হোয়াইট গোল্ড হিসেবে পরিচিত চিংড়ি মাছের রেনু সরবরাহে নীতিমালা। বেশীর ভাগ রেনু ঘেরে ছাড়ার আগেই মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে অনেকের। হ্যাচারী গুলোর প্রতারনার শিকার চিংড়ি চাষীদের বিঘা প্রতি চাহিদার কয়েক গুন বেশী চিংড়ি রেনু ছাড়তে হচ্ছে ঘেরে। এরফলে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, তেমনি উৎপাদনও কম হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঘের মালিকরা।
জেলায় আধা নিবিড়, নিবিড় সহ বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে চিংড়ির রেণু আসে মুলত কক্সবাজারের বিভিন্ন হ্যাচারী থেকে।
এসব রেণু পরিবহনে দীর্ঘ সময় লাগার কারনে পোণার গুনগত মান কমে যায়। তাছাড়াও ঘেরে ছাড়ার আগেই বেশীর ভাগ রেণু অক্সিজেন ফেল করায় ও গরমে মারা যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
কক্সবাজারের রেণু মারা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে কক্সবাজারের হ্যাচারী প্রতিনিধিরা বলছেন, ভারতীয় রেণু ফেলায় ঘেরে মাছ টিকছে না। তবে কক্সবাজার থেকে নোফলি এনে সাতক্ষীরার হ্যাচারীতে যদি প্রডাকশান দেয়া যায়, তাহলে চিংড়ির উৎপাদন বেড়ে যাবে।
চাষীদের দাবী তারা স্থানয়ি চিংড়ি পোণা হ্যাচারী গুলোর পোনা ছেড়ে অনেক লাভবান হচ্ছে । তাই এ অঞ্চলে হ্যাচারি শিল্প ধরে রাখতে ও একই সাথে বৈদেশিক মৃদ্রা অর্জনে সহায়তার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে মা মাছ সংরক্ষনের দাবী সাতক্ষীরার হ্যাচারী মালিকদের।
ঘের মালিক আব্দুল মাজিদ বলেন সাতক্ষীরা হ্যাচারীতে উৎপাদিত রেনু মাটি ও পানির সঙ্গে সহনশীল বলেই ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে ।
সাতক্ষীরা নিউমার্কেট সংলগ্ন হ্যাচারী প্রতিনিধি আখি ফিসের মালিক বিশ্বজিত জানান,বর্তমানে জেলাতে চিংড়ির রেণুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরবরাহ কম থাকা এবছর দাম একটু বেশি।
চিংড়ি রেণু কিনতে আসা আশাশুনির পূর্ব কাঁদাকাটি এলাকার দিপঙ্কার জানান,রেণু সংকটের কারণে সে যথা সময়ে ঘেরে পোনা ছাড়তে পারছে না। ৫ বিঘা জমিতে সে ঘের করে। তার চহিদা স্থানীয় হ্যাচারীতে উৎপাদিত রেণু সংগ্রহ করতে । কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় স্থানীয় পোণা না পেয়ে বাইরে থেকে আসা রেণু কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এমন অবস্থা প্রায় সব চাষীদের।
সাতক্ষীরা চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. আবুল কালাম বাবলা বলছেন, রেণুর গুণগত মান ভালো, তবে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কক্সবাজার থেকে নিয়ে আসা রেণু তাপমাত্রার ব্যবধানের কারনে চাষীরা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাঁর পরামর্শ স্থানীয় হ্যাচারী থেকে উৎপাদিত রেণুর গুণগত মান অনেক ভাল। সরকারী ভাবে জেলাতে আরো বেশি হ্যাচারী গড়ে তুলতে পারলে চিংড়ি খাত ব্যাপক সফালতার মুখ দেখবে। সরকার এ খাত থেকে কয়েক গুণ বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
সরকারি নীতিমালা মেনে রেণু পোনা সরবরাহ ও বিপণনের কথা জানালেন সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। তিনি সময়ের কারনে কক্সবাজার থেকে আনা রেনুর গুনগত মান নষ্ট হওয়ার সত্যতা স্বীকার করে জানান, সাতক্ষীরায় মা মাছ সংরক্ষনে সরকারী ভাবে উদ্যোগ নিলে চাষীরা ভাল মানের রেনু পাবে। আর ২/৩ বার রেনু ঘেরে ছাড়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলাতে নতুন নতুন হ্যাচারী গড়ে তোলা হবে।