রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: টেলিগ্রাফ

বাংলাদেশের অভিজাত আধা সামরিক বাহিনীর অপরাধ বিরোধী টাস্কফোর্স যখন হাবিবুর রহমানকে গত মাসে হত্যা করলো তখন কর্মকর্তারা সেই একই কাহিনী বললেন, কিভাবে হাবিবুর রহমান তার শেষ পরিণতি ভোগ করলেন। তারা বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন এই অভিযুক্ত মাদকের ব্যবসায়ী। বলা হয়েছে, তিনি ও তার সহযোগীরা লুকিয়ে ছিল এবং সেখান থেকে প্রথমেই পুলিশের প্রতি গুলি ছোড়ে। সরকার মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ দমন পীড়ন শুরু করেছে তার প্রেক্ষিতে প্রতিদিনই র‌্যাব, পুলিশের হাতে এমন হত্যার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তের একই রকম সহিংসতার আশ্রয় নেয়ার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। মাত্র ১৫ দিনে বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে ১২০ জনকে।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ। এর বিবরুদ্ধে এই অভিযান চলছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে অভিযোগ উঠেছে যে, এ বছর জাতীয় নির্বাচন সামনে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ভীতি সৃষ্টি ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযান। নিহত হাবিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, ৪২ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান প্রধান বিরোধী দলের একজন সক্রিয় কর্মী। তাকে হত্যা করা হয় আত্মগোপনে থাকা দেখিয়ে। তবে তাকে ঘটনার আগে চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর কিচু মানুষ পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখা গেছে। ওইসব মানুষ ছিল সাদা পোশাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য। এ নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না নিকট আত্মীয়রা। তবু তাদের একজন বলেছেন, হাবিবুর রহমান মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর তাকে তুলে নেয়া হয়। এরপর তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয় তাকে। তিনি মাদক ব্যবসায়ীও নন। মাদকে আসক্তও নন। তিনি ছিলেন সরকার বিরোধী রাজনীতির যুক্ত। প্রতিবাদ করেছিলেন ভূমি বিষয়ক একটি বিষয়ে। এ জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভয়াবহ এই রক্তপাত ও ‘সামারি এক্সিকিউশন’ নিয়ে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট বলেছেন, যে পরিমাণ মানুষ নিহত হচ্ছেন তাতে অবশ্যই আমি উদ্বেগ প্রকাশ করি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকেরই প্রচলিত আইনে বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকেরই যথাযথ প্রক্রিয়ার সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে গণতন্ত্রে। কিন্তু যদি জনগণের মধ্যে সহিংস বিরোধ বা কনফ্রন্টেশন লেগেই থাকে তাহলে সেখানে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে লক্ষ্য হওয়া উচিত শূণ্য সহনশীলতা। এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে এবং সবাইকে বিচারের মুখোমুখি আনতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদক সেবী আছে। এর মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগই ইয়াবাসেবী। এই ইয়াবা সীমান্তজুড়ে প্রবেশ করে। বিশেষ করে তা আসে মিয়ানমার থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মে মাসের শুরুর দিকে মাদক বিরোধী অভিযান চালু করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে মাদকের ভয়বহতা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। মাদকের কোনো গডফাদারকে ছেড়ে দেয়া হবে না। তিনি আরো বলেছেন, কোনো নিরপরাধ মানুষকে হযরান বা টার্গেট করা হচ্ছে না। যদি এমনটা হয়েই থাকে তাহলে বিষয়টি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো অন্যায় বা ভুল হওয়ার কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসুদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড নয়। শুধু যখনই আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়ে তখনই আমাদের সেনারা অস্ত্র ব্যবহার করেন।
বিভিন্ন সূত্র দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, যেদেশে মাদক একটি লোভনীয় ব্যবসা, সেখানে রাজনীতি ওও পুলিশের দুর্নীতি জড়িয়ে আছে। তাই প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য মোক্ষম সুযোগগ হিসেবে এই দমনপীড়ন অভিযান ব্যবহার করে থাকতে পারেন অফিসাররা। এর মধ্য দিয়ে নিহতের সঙখ্যা বাড়ছে। যারা মোটামুটি জানেন তাদেরকে নিস্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। নিহতের পাশাপাশি ৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বনের সামান্যই প্রয়োগ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৭ হাজারের বেশি মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে বিচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বারু। তিনি এ্ অভিযানকে বে আইনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, দৃশ্যত এতে বিচারক, জুরি ও শাস্তিদাতা হিসেবে কাজ করছে পুলিশ। তার মতে, এই অভিযান দিয়ে মাদকের ব্যবসা সামান্যই থামানো যাবে। কারণ, এ ব্যবসা বিস্তৃতি, অনেক গভীরে। পক্ষান্তরে এই অভিযান হলো এ বছরের শেষের দিকে যে জাতীয় নির্বাচন সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি। তার ভাষায়, এমনকি নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে থাকবে ততই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও অন্যান্য অজুহাত দাঁড় করে সরকারের হাতে নিহত হবে আরো অনেক মানুষ। মেথামফেটামিন নামের ইয়াবা ট্যাবলেরে জোয়ার শুরু হয়েছে মিয়ানমার থেকে। তা ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া। গত সপ্তাহে ক্রিস্টাল মেথামফেটামিনের বিশাল একটি চালান জব্দ করেছে মালয়েশিয়া। সেখানকার কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে শিপমেন্টে হলুদ চা পাতার প্যাকেটে করে পাঠানো হয়েছিল ১.২ টন মেথামফেটামিন। এ বছরের শুরু থেকে অভিযান শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। সেখানে রেকর্ড পরিমাণ এই নেশাদ্রব্য জব্দ হয়েছে। মাদকের এই বাজার উদ্বেগজনকভাবে, ভয়াবহ গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও এশিয়ার অনেক দেশ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেমনটি হয়েছে ফিলিপাইনে। সেখানে ঠান্ডা মাথায় কয়েক হাজার মাদক সেবী ও বিক্রেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য এই নেতার সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছে মিয়ানমার। এ দেশটির সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগই অরিক্ষিত।

Check Also

ভোমরা সীমান্ত থেকে ১০পিস সোনার চকলেটসহ আটক-১

নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের ফলমোড় এলাকা থেকে ১০পিস সোনার চকলেটসহ সুমন ইসলাম নামের এক কিশোরকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।