এম জিললুর রহমান: পুলিশের মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে চুনোপুটিরা আটক হলেও ধরাছোয়ার বাইরে রাঘববোয়ালরা। ইতোমধ্যে পুলিশের দাবি অনুযায়ী ৫জন মাদক ব্যবসায়ী অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গোলাগুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটলেও এদের মধ্যে তালিকাভুক্ত ২জন বলে জানা গেছে। বাকি ৩জনের মধ্যে দুইজনের নামে রয়েছে কয়েকটি করে মাদকের মামলা। অপর জনের নামে একটি জিডিও নেই। অপর দিকে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় ১১জন শীর্ষ, আর ৪০ জন খুচরা মোট ৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে তাদের তালিকায় জেলা ব্যাপি নাম রয়েছে ৩০৪ জনের। ফলে সরকারের দুটি সংস্থার দুই ধরণের তালিকা নিয়ে রয়েছে নানা কথা।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, পুলিশের হাতে থাকা তালিকানুযায়ী জেলায় মাদক বিক্রেতার সংখ্যা ৩০৪ জন। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর থানায় ১২৮ জন, কলারোয়া থানায় ৩১জন, আশাশুনি থানায় ৭৪ জন, তালা থানায় ১৩জন, কালিগঞ্জ থানায় ১৫জন, শ্যামনগর থানায় ১৭জন, দেবহাটা থানায় ৭জন ও পাটকেলঘাটা থানায় রয়েছে ১৯জন মাদক বিক্রেতার নাম।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা সার্কেলের পরিদর্শক লাকিয়া খানম জানান, তাদের তালিকানুযায়ী জেলার ১১জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ৪০ জন খুচরা মাদক ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। তবে এসব তালিকা অনেক পুরানো ও দূর্বল বলে সূত্র জানায়। এই বিভাগের ১১ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে নাম রয়েছে শ্যামনগরের চন্ডিপুরের হামীদ শেখের ছেলে শেখ মুনসুর আলী, পলাশপোলের কোর্টের সামনে পাইলস নুর ইসলাম ডাক্তারের ছেলে সোহেল রানা। সদরের বৈকারি গ্রামের মৃত আব্দুল গাজীর ছেলে আক্কাজ আলী। দেবহাটার সখিপুরের আবু বক্করের ছেলে আশরাফ আলী। সদরের ভবানিপুর গ্রামের মাজেদ দালালের ছেলে নাসিম দালাল। শহর উপকণ্ঠের চালতেতলা এলাকার আব্দুস জলিলের ছেলে আশরাফুল ইসলাম। গড়ের কান্দার সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী মাহফুজা খাতুন। কলারোয়ার ঝিকরা গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে আমিনুর রহমান রিংকু। শহরের মধুমল্যারডাঙ্গী টার্মিনাল এলাকার মৃত ইরাদ আলীর ছেলে মফিজুল ইসলাম। সদরের পাচানী আলিপুর এলাকার ফজর আলীর ছেলে সোহরাব হোসেন ও দেবহাটার দক্ষিণ পারুলিয়া গ্রামের মৃত কেরামত আলীর ছেলে আব্দুল হামিদ মোল্যা।
এছাড়াও এ দপ্তরের আরো খুচরা ৪০ জনের তালিকায় নাম রয়েছে, কালিগঞ্জের সুলতানপুরের ফজর আলীর ছেলে ভুট্টো, একই উপজেলার রতনপুর গ্রামের মৃত খগেনের ছেলে উজ্জল কুমার, শ্যামনগরের হাজীপুর গ্রামের রওশন আলীর ছেলে বিল্লাল হোসেন। দেবহাটার সখিপুর গ্রামের মৃত আক্তার গাজীর ছেলে আনারুল ইসলাম, আশাশুনির গুনাকরকাটির ওজিয়ার রহমানের ছেলে বাবুল, দেবহাটার বহেরা পূর্ব পাড়ার নুর আলীল ছেলে নুর ইসলাম ওরফে ছোট, কালিগঞ্জের নারায়নপুরের খাপু শেখের ছেলে আব্দুর রহমান, কালিগঞ্জের কাকশিয়ালী গ্রামের জনাব আলী ফকিরের ছেলে শাহাদাৎ হোসেন, সদরের নবাতকাটি গ্রামের ইসমাইলের ছেলে শহিদুল ইসলাম, কালিগঞ্জের সাদপুর গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান। দেবহাটার পারুলিয়ার শহিদুলের ছেলে আজহারুল ইসলাম, শ্যামনগরের বংশিপুরের ইন্তাজ গাজীর ছেলে ইসরাফিল গাজী, দেবহাটার সখিপুরের তারক ঋষির ছেলে অনন্ত ঋষি, কালিগঞ্জের নারায়ণপুরের বিরু ঋষির ছেলে অশোক ঋষি, দেবহাটার দক্ষিণ কুলিয়ার মৃত হাসানের ছেলে বাবু সরদার, কালিগঞ্জের উজিরপুরের মৃত ছমির উদ্দীনের ছেলে মকবুল হোসেন গাজী, একই এলাকার হাজিম সরদারের ছেলে মফিজুল ইসলাম, একই উপজেলার দাদপুর গ্রামের বাবর আলীর ছেলে লুৎফর রহমান, দেবহাটার বসন্তপুর গ্রামের মৃত লালু দাসের ছেলে জহর দাস, কালিগঞ্জের মৌতলার মৃত এলাহী বক্সের ছেলে আবু সাদেক, শ্যামনগরের বাধঘাটা গ্রামের মৃত বিশে গাজীর ছেলে খোকন গাজী, দেবহাটার পুস্পকাটির কোরবানের ছেলে মিলন সরদার, একই এলাকার কাশেম আলীর ছেলে শফিকুল ইসলাম, দেবহাটার বহেরার মোনাজ উদ্দীনের ছেলে আজগর আলী, শ্যামনগরের চালিতাঘাটার আনসারের ছেলে মিন্টু, দেবহাটার বহেরা ঢালী পাড়ার রফিকুলের ছেলে ইছানুর রহমান, কালিগঞ্জের উজিরপুরের মনোরঞ্জন ঋষির ছেলে গোবিন্দ ঋষি, একই উপজেলার দুরপুড়িয়া গ্রামের জহুর আলীর ছেলে আব্দুর রশিদ ওরফে বুলু, তারালী ঘোষপাড়ার মোনাজাতের ছেলে ফারুক হোসেন, কুলিয়া উত্তর পাড়ার মৃত আলিম মেন্বরের ছেলে ইব্রাহিম খোকা, সখিপুরের জামারাত আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, দেবহাটার রামনাথপুরের ধীরেন্দ্র দাসের ছেলে কালিদাস, আশাশুনির সদকোনা গ্রামের আক্তার মিস্ত্রির ছেলে খায়রুল আলম, শ্যামনগরের বিড়ালক্ষী গ্রামের চাহর আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম, কালিগঞ্জের ব্রজপাটুলি গ্রামের পঞ্চানন দাসের ছেলে অরুণ দাস, শ্যামনগরের বন্যতলা উত্তর পাড়ার সলেমান মোল্যার ছেলে লাভলু মোল্যা, উপজেলার বংশিপুর গ্রামের ইশরাফিল গাজীর ছেলে ওমর ফারুক ও একই এলাকার ইনতাজ গাজীর ছেলে ইসরাফিল গাজী।
এছাড়াও তালিকার ৭ ও ৮নং তালিকাভুক্ত একই ব্যক্তি বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কথিত এই তালিকা অনেকটাই দায়সারা গোছের এবং প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আড়াল করে চুনোপুটিদের সামনে আনা হয়েছে।
এদিকে দু’একটি এলাকায় খোজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সদরের খানপুর গ্রামের মিজান শেখ ও তার স্ত্রীর নামে কয়েকটি মামলা আছে। এরা স্বামী ও স্ত্রী মিলে ফেন্সিডিলের ব্যবসা করে। সদরের শিকড়ী গ্রামের মৃত শামসুদ্দিনের ছেলে মইজদ্দীন টুলুর নামে রয়েছে ডজনের অধিক মাদক মামলা। ৪/৫ মাস আগে শহর উপকণ্ঠের লাবসা এলাকার একটি ভাড়াবাড়িতে থাকা দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার হেফাজত থেকে ৭০০ পিছ ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আটক করে। অথচ শীর্ষ এই ফেন্সিডিল ও ইয়াবা ব্যবসায়ী মইজদ্দীন টুলুর নাম মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় নেই। এছাড়াও নেই, নারানজোল গ্রামের মৃত হোসেন মোড়লের ছেলে ফেন্সি হবি মোড়ল, তার নামে রয়েছে একাধিক মামলা। বাশদহা গ্রামের আতিয়ার দালালের নামে কয়েকটি ইয়াবার মামলা থাকলেও নেই তালিকায় নাম। অভিযোগ রয়েছে এই জেলায় ইয়াবার সর্বপ্রথম আনায়নকারি হিসেবে আতিয়ারের নাম পাওয়া যায়। শহর উপকন্ঠের মিল বাজার এলাকার আব্দুল লতিফ ও তার বড় ভাই আব্দুর রউফ দুজনই গাজার ব্যবসায়ী। দু’সহদরের নামে রয়েছে হাফ ডজনের অধিক মামলা। বর্তমান সময়ে পরিস্থিতি বুঝে আব্দুল লতিফ এখন ইজিবাইক চালক। সদরের লাবসা গ্রামের গাঁজা স¤্রাট নামে পরিচিত টার্মিনালের গাঁজা ব্যবসায়ী স¤্রাটের নামে কয়েকটি মামলা থাকলেও তালিকায় তার নাম নেই। বাশদহা গ্রামের গোলাম বারীর নামে কয়েকটি ফেন্সিডিলের মামলা থাকলেও তালিকা বর্হিভূত সে। বাশদহা কাজী পাড়ার ডাবলু, এলাকার বিশিষ্ট গাজা ব্যবসায়ী। একই এলাকার মহসিনের ছেলে জাফর ও মোন্তার ছেলে লাভলুর বিরুদ্ধে গাঁজা ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে তাদের নামে কয়েকটি করে মামলাও। তলুইগাছা গ্রামের হাসান, রবিউল, রুহুল আমীন, কালু, ওহাবের ছেলে খোরশেদ এরা গাঁজার চালান ব্যবসায়ী বলে দাবী এলাকাবাসির। রয়েছে একাধিক মাদকের মামলাও। দুই এক কেজি নয়, মন মন গাঁজা ভারত থেকে আনলেও তালিকায় তাদের নাম নেই। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এসব ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে সুযোগ সুবিধা নেয়ার কারণেই তালিকায় তাদের নাম নেই বলে অভিযোগের তীর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে সোমবার দুপুরে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা সার্কেলের দায়িত্বরত পরিদর্শক লাকিয়া খামন সেল ফোনে জানান, তালিকায় ত্রুটি থাকতে পারে। আমি মহিলা মানুষ সব জায়গায় যেতে পারিনা। আমার অফিসাররা যা সহযোগিতা করে সেভাবেই কাজ করি। যদি ত্রুটি থাকে এবং প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীর নাম তালিকায় না আসে সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান জানান, গত পহেলা রমজান থেকে জেলায় মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। কত দিন এ অভিযান চলবে এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেই পুলিশ হেডকোয়ার্টাস থেকে জানানো হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, এপর্যন্ত পুলিশের অভিযানে ১১৪ জন মাদক ব্যবসায়ী বা এর সাথে সংশ্লিষ্টদের আটক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ মে রাতে সদর উপজেলার পরানদহ গ্রামের আজিজ দালালের মরদেহ পাওয়া যায় কালিগঞ্জের হিজলা চন্ডিপুর এলাকায়। ২৫ মে রাতে কলারোয়া উপজেলার ভাদিয়ালী গ্রামের ইউনুছ আলী দালালের মরদেহ পাওয়া যায় উপজেলার বড়ালী এলাকায়। ২৮ মে রাতে সদরের মেডিকেল কলেজের পেছনে গোলাগুলিতে মারা যায় ভোমরার পুটে ও টার্মিনাল এলাকার এমদাদুল হক। গত ২৯ মে ভোরে কলারোয়ার পাকুড়িয়া গ্রামের আনিসুর রহমান নামের এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর মরদেহ চিতলা মাঠ এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। প্রত্যেকটি ঘটনায় কিছু মাদক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার রয়েছে। পুলিশ বলছে মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই এরা মারা গেছে।
Check Also
তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন
তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …