–প্রভাষক বি এইচ মাহিনী‘মাদক’ নামটা শুনলেই আত্কে ওঠেন সচেতন ও সাধারণ সকল মানুষ। হ্যাঁ, সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম হাতিয়ার এই মাদক ও জুয়া। মহানবী স. বলেন, ‘মাদক হলো বহু পাপের সমন্বয়ক।’ আজকের বাংলাদেশে সামজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে এই মরণ ব্যাধির মহাছোবল। মেডিকেল সায়েন্স বলছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তির সন্তান সাধারণত মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকলঙ্গ হয়ে থাকে। মাদক ও জুয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করে অশান্তি ও অবিশ্বাস। মাদকের ভয়াল গ্রাসে আজ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ বিশেষত উঠতি বয়সী যুব সমাজ ধ্বংস হচ্ছে। এমতাবস্থায় মাদক ও মাদকাসক্তদের সমূলে নির্মূলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও প্রশাসনের দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান জনমনে শস্তি ও শান্তির বারতা নিয়ে এসেছে। মাদক-জুয়া-সন্ত্রাস ও অরাজকতার বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম চলমান থাকুক এ প্রত্যাশা আজ দেশবাসীর। তবে অন্যায়ভাবে নির্দোষ নিরপরাধ মানুষ এবং মাদক কারবারীদের বিনা বিচারে চলমান এ হত্যাকা-ের নিন্দা ও উদ্বেগও প্রকাশ করছেন অনেকে। মাদক ও জুয়ার সাথে সম্পৃক্ত সবাই বিশেষভাবে নেশাগ্রস্থ ও আসক্ত। মাদককের পরিচয় ও এর বিধান বর্ণনা করে আজ থেকে প্রায় পনেরো শত বছর পূর্বে বিশ্বনবী মুহাম্মদ স. বলেছেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক বস্তুই হলো মদ/মাদক। আর সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ।’ (আবু দাউদ, ৩য় খ-, ৩৬৮৭) এছাড়া জামি আত্-তিরমিযি শরীফের ৪র্থ খ-ের ১৮৬৫ নং হাদিসে প্রিয় নবী স. বলেছেন, ‘যে বস্তুু অধিক পরিমান ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি করে, এর সামান্য পরিমানও হারাম বা নিষিদ্ধ।’
মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে মহানবী স. বলেন, ‘মদ/মাদক ফেলে দাও এবং এর পানপাত্রগুলো ভেঙ্গে ফেলো।’ (আবু দাউদ, ৩য় খ-, ৩৬৭৭) মাদকের পরিণতি বর্ণনা করে নবিজী স. মুসনাদে আহমাদের ৫ম খ-ের ২২৩৬১ নং হাদিসে বলেন, ‘দুনিয়ায় যে ব্যক্তি ১ ঢোক মদ বা মাদক সেবন করবে; পরকালে তাকে জাহান্নামের পচা পুঁজ পান করানো হবে।’ এছাড়াও তিনি বলেন, ‘৩ শ্রেণির মানুষের জন্য জান্নাত হারাম। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণি হলো নিত্য মদপানকারী।’ (মুসনাদ আহমাদ, ২য় খ-, ৫৩৭২)
মাদক ও জুয়া সম্পর্কে মাহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ২১৯ নং আয়াতে বলেন, ‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলুন; এর মধ্যে রয়েছে ভয়াবহ (বড়) পাপ।’ সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াতে মহান রব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা পূজা এবং ভাগ্য নির্ধারক শর (তীর) এসব শয়তানের অপবিত্র কর্ম বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাকো-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রপ্ত হও। এরপর ৯১ নং আয়াতে বলেন, ‘শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ এবং সালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে।’
পৃথিবীতে যত পাপ, অন্যায়-অবিচার, খুন-ধর্ষণ, হত্যা-লুটতরাজ ও অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার বেশিরভাগ সংঘটিত হয় মাদক ও জুয়ার মাধ্যমে। কেননা, এর বিকিকিনিতে অবৈধ লেনদেন ও অপব্যয়-অপচয় হয়। মহানবী স. মাদককে সকল অন্যায়ের চাবিকাঠি উল্লেখ করে ঘোষণা করেন, ‘মদ/মাদক পরিহার কর, কেননা মাদক হলো প্রত্যেক অন্যায়ের চাবিকাঠি।’ (ইবনে মাজাহ্, ৩৩৭১) পবিত্র কুরআনের সুরা বনী ইসরাইলের ২৬-২৭নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’
মাদকসেবন কারীরা মূলত নিজ হাতে নিজকে এবং অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে থাকে। তাই এমন আত্মঘাতি কাজ থেকে নিবৃত থাকতে মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাারার ১৯৫ নং আয়াতে বলেছেন, ‘আর ব্যয় করো আল্লাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে নিজ হাতে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন।’
মাদক প্রতিরোধে প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা একান্ত দরকার। এজন্য, (১) ধর্মীয় আক্বিদাহ্ (দৃষ্টিভঙ্গি) সুস্পষ্ঠ থাকতে হবে। স্ব স্ব ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অনুশীলন থাকতে হবে। মাহনবী স. বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বাহ্যিক চেহারা-সুরত ও অর্থ-বিত্ত দেখবেন না, বরং তিনি দেখবেন তোমাদের অন্তর বা বিবেক (বিশ্বাস) এবং আমল বা কর্ম।’ (২) আত্মশুদ্ধি : মাদক-জুয়াসহ সব ধরণের অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে থাকতে আমাদের আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এ কারণে পবিত্র কুরআনে মহান রবের কাছে পরিশুদ্ধ ও নিষ্কলুষ আত্মা নিয়ে হাজির হওয়ার কথা বলা হয়েছে। (৩) তাকওয়া বা সৃষ্টিকর্তাভীতি : মাদক ও নেশা থেকে পরিত্রাণ পেতে খোদাভীতি জাগ্রত করা আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এটা সেই কিতাব; যাতে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। এবং এ কিতাব খোদাভীরু (মুত্তাকী) মানুষদের জন্য পথপ্রদর্শক।’
(৪) ইহসান প্রতিষ্ঠা : ইহসান হলো সহানুভূতি, সমতা, পরোপকার, ন্যায়নীতি ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনের সূরা নহলের ৯০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ করেছেন আদল (ন্যায়বিচার) ও ইহসান (সহানুভূতি বা সমতা) প্রতিষ্ঠার ব্যপারে।’ (৫) তাওয়াক্কুল আ’লাল্লাহ : মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা। আসমান ও জমিনের সকল গায়িবের (অদৃশ্য) খবর তিনিই রাখেন। তিনিই রিযিক দান করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো জীব নেই, যার রিজিকের দায়িত্ব আমার (আল্লাহর) নয়।’ (৬) সবর বা ধৈর্য্য ধারণ : সকল বিদপ মুসিবতে ধৈর্য্য ধারণ করা। পবিত্র কুরআনের সুরা লুকমানের ১৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে প্রিয় বৎস, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে; এবং সকল বিপদ মুসিবতে ধৈর্য্য ধারণ করবে।’ (৭) মৌলিক ও নফল ইবাদত পালন : পবিত্র কুরআনের সুরা আনকাবুতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় সালাত মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ এ ছাড়াও মহানবী স. বলেছেন, ‘সওম বা রোজা হলো (সকল পাপ কর্মের) ঢাল স্বরূপ।’
(৮) ইসলামি সভ্যতা ও পরিবেশ সৃষ্টি : মাদক ও জুয়া নির্মূলে সমাজকে আদর্শিক মূল্যবোধের উপর দাঁড় করাতে হবে। পবিত্র কুরআনের সুরা ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি উম্মাহ (গোষ্ঠী) থাকবে যারা মানুষকে ভালোর দিকে কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে।’ (৯) পারস্পারিক উপদেশ আদান-প্রদান : সন্তান ও জুনিয়রদেরকে বয়ো:জ্যোষ্ঠরা বিভিন্ন সময়ে উপদেশ নসিহত প্রদান করবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপন পালনকর্তার পথের প্রতি মানুষদের আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশসহ উত্তম পন্থায় এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন সুন্দর ও পছন্দযুক্ত পন্থায়।’ (১০) আখেরাতের চেতনা : মাদক ও জুয়াসহ সকল পাপকর্ম মুক্ত একটি কল্যাণকর সুন্দর সমাজ বিনির্মানে পরকালের চিন্তা এবং পেরেশানী থাকা একান্ত জরুরী। পবিত্র কুরআনের সুরা আল আ’লার ১৬-১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বস্তুত: তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।’
সর্বোপরি মাদক-জুয়া নির্মূলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকাও খুবই দারকার। কেননা শাস্তি ছাড়া সমাজে শান্তি ফিরে না। তাই সমাজের কীট ও পশুরূপী মানুষ নামের অমানুষগুলোকে আত্মসমর্পণ করাতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
লেখক : পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণ-গ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।