সম্প্রতি ভারত থেকে ঘুরে এসেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলটির পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসছে কিনা অনেকের মনে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আসলে বিএনপির পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসছে কিনা তা এখনই বলা যাবে না। এজন্য দলটির ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই দেখা যাবে সত্যিকারার্থে তারা নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন এনেছে, নাকি আগের অবস্থানেই রয়েছে। একটা বিষয় আমরা দেখেছি, গত নির্বাচনের সময় বিএনপির মধ্যে পরিস্থিতি পরিবর্তনের একটা মনোভাব ছিল। সে অনুযায়ী তারা চেষ্টা করেছে, এমনকি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে বিএনপির চেয়ারপারসন তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেননি। যদিও দেখা করার একটা বিষয় ছিল।
তখনকার রাজনীতির বিষয় ছিল ভিন্ন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি আরেক ধরনের। এবার এটা পরিষ্কার যে বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে এবং যত বিপদই আসুক তারা নির্বাচনমুখী বলেই মনে হচ্ছে। তা যদি হয়, সেক্ষেত্রে আমি মনে করি বিএনপি প্রতিনিধিদলের ভারত সফর ছিল মূলত ভারতকে পরিস্থিতি বোঝানোর বিষয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল এবং তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি বদলাতে পারে; কিন্তু তেমনটি ঘটেনি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি প্রতিনিধি দল যে ভারত সফর করেছে এবং তাদের বিভিন্ন বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এটা অস্বাভাবিক নয়। এর কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলও ভারত সফর করেছে এবং সেখানকার বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বসেছে। ফলে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সফরে নতুনত্বের কিছু নেই; বরং এটা ধারাবাহিকতা মাত্র। তবে এ কারণে যে আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বড় পরিবর্তন আসবে, তা আমি মনে করি না। নির্বাচন যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ ফোল্ডারগুলোর ভূমিকাই আসল। বিএনপির সঙ্গে কম এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের একতরফা সম্পর্ক হলেও নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটা বেশি ভূমিকা রাখবে না।
বিএনপি প্রতিনিধি দলের সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে কিনা, তা বলা মুশকিল। লক্ষণীয় বিষয়, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও চীনের সঙ্গেও সরকার ভালো ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা কিনা আগে বিএনপির সঙ্গে বেশি ছিল। বিষয়গুলো তারা বিবেচনায় নিতে পারে। সে মোতাবেক সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্কের ওপর জোর দিতে পারে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে একটা কনসেনসাস তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় ভারতের ক্ষেত্রেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার একটি কনসেনসাস তৈরি হচ্ছে। তবে সেটা কতখানি, তা ভবিষ্যতে বলা যাবে।
দেখা দরকার নির্বাচনে তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে। আমি মনে করি না, খুব একটা প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্ব পায় তার মধ্যে রাজনৈতিক দলের বাইরে অভ্যন্তরীণ ফোর্সগুলোও অন্যতম। গত নির্বাচনের পর আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনা, পরিবর্তন ও গ্রহণযোগ্য আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু কিছুই হয়নি। নির্বাচনের পর থেকে পরিবর্তন আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো জোরালো কোনো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারেনি। বিএনপি এখন যেটা চাচ্ছে তা হল- জনগণের ব্যাপারে, রাজনৈতিক মহলের ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়, মানুষের মনোভাব ইত্যাদি তারা ভারতের কাছে পরিষ্কার করতে চাইছে, যাতে করে নির্বাচনের সময় দেশটি নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখে।
বিএনপির প্রতিনিধি দল বলছে, তারা চায় জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ভিত্তিতে দুই দেশের সমঝোতা গড়ে উঠুক। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে ভারতের একটি দুর্বলতা আছে। তারা জনগণের চেয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজটি বেশি করে। কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, নেপাল ও শ্রীলংকার বেলায়ও তা দেখা গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে সম্পর্ক গুরুত্ব পায় না। তাতে ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়ে যায়। চীন কিন্তু জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে জোর দেয়। অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। বিজেপি এখন ক্ষমতায়। তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে। এক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে দলের সঙ্গে ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে কিন্তু কারও খুব একটা লাভ হয় না। যেমন- রাজীব গান্ধীর সঙ্গে শ্রীলংকার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশটি তাকে পাশ কাটিয়ে চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করেছে। আমাদের বেলায়ও আমরা দেখেছি মিয়ানমারের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যা আশা করেছে, ভারতের কাছ থেকে তা পায়নি।
এ কারণে সম্পর্কের কনসেপ্ট পরিবর্তন হচ্ছে। একতরফা বা একদলীয় সম্পর্ক হলেও সব ক্ষেত্রে সমর্থন না পাওয়ার নজির একেবারে কম নয়। বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে সম্পর্কের কনসেপ্টে পরিবর্তন হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত যে কোনো দলের বা সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে কতটুকু পরিবর্তন আসবে, তা দেখতে তাদের ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। (অনুলিখন)
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়