ক্রাইমবার্তা রিপোট: রুশ বিপ্লবের পর ভলগা নদীতে অনেক জল বয়ে গেছে। জার শাসনামলের অবসান ঘটিয়ে লেনিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৭৪ বছর পর লেনিন-স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের ভরা সংসারে ফাটল ধরল। ‘মা’র স্রষ্টা ম্যাক্সিম গোর্কির মাতৃভূমি ভেঙে ১৫ টুকরো হয়ে গেল। আর লেভ ইয়াসিন? সেই বিশ্বনন্দিত গোলপ্রহরী।
পেলেকে অবাক করে দিয়ে যিনি উল্টোদিকে ঘুরে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন নিশ্চিত গোল। ১৫০টি পেনাল্টি সেভ করা ইয়াসিন আজ নিশ্চয়ই দূর আকাশের তারা হয়ে তাকিয়ে থাকবেন মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের দিকে। লেনিন-স্তালিন হয়তো ধন্যবাদ জানাবেন ভ্লাদিমির পুতিনকে! ‘আমরা যেটা পারিনি, তুমি সেটা করে দেখিয়েছ। বেঁচে থাকো বাছাধন!’
গ্লাসনস্ত পেরিয়ে পুতিনের পেরেস্ত্রইকার হাত ধরে রাশিয়া পুষ্পিত, পল্লবিত হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সিনেমায়, ব্যালে নৃত্যে রুশদের পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত। অর্থনীতিতেও তারা এখন সবল ও শক্তিশালী। একটাই আক্ষেপ ছিল তাদের এতদিন।
ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজন করতে না পারা। সেই আক্ষেপও ঘুচল পুতিন জমানায়। অপেক্ষার প্রহর শেষে আজ যার দ্বারোদঘাটন হচ্ছে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। ৮১ হাজার আসনের রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামে আজ বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় আর্জেন্টাইন রেফারি নেস্তর পিতানার প্রথম বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে ২১তম বিশ্বকাপ।
উদ্বোধনী ম্যাচে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে লড়বে স্বাগতিক রাশিয়া, এটা তো সবারই জানা। তার আগে প্রথামাফিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যেখানে পারফর্ম করবেন নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ব্রিটিশ পপতারকা রবি উইলিয়ামস এবং বিশ্বখ্যাত রুশ গায়িকা আইদা গারিফুল্লিনা।
তাদের সঙ্গে পারফর্ম করবেন পাঁচশ’ নাচিয়ে ও জিমন্যাস্ট। ৯০ মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর ফুটবলযুদ্ধ শুরুর আগে সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হবেন এই গ্রহের অগুনতি ফুটবলপ্রেমী। চার বছর পরপর বিশ্বকাপ আসে। ফুটবলের এই বৈশ্বিক আসরে ৩২ দল ৩২ দিন রাশিয়ার ১১ শহরের ১২টি স্টেডিয়ামে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে ৬৪ ম্যাচে।
পাঁচ কেজি খাঁটি এবং ১৮ ক্যারটের ৬.১৭৫ কিলোগ্রাম স্বর্ণের ট্রফির জন্য ৭৩৬ জন খ্যাত-অখ্যাত ফুটবলারের লড়াই থামবে আগামী ১৫ জুলাই। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ হবে একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চম ফিফা বিশ্বকাপ। কার হাতে ট্রফি উঠবে- এই প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতে তোলা রইল।
বিশ্বকাপ এই গ্রহের সর্বত্র উৎসব ও উন্মাদনার বাতাবরণ তৈরি করে। বাংলাদেশের খেলাপ্রিয় মানুষরাও এই এক মাস বিভোর থাকেন ফুটবলে। বিশ্বকাপে ৩২ দল খেলে বটে, কিন্তু বাংলাদেশের শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ দেখে মনে হয়, বিশ্বকাপ বুঝি দু’দলের আসর।
এই দুই দল যে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, একথা কে না জানে। এবার আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শুরু হবে ১৬ জুন। বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে আসা মাত্র সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যার দেশ আইসল্যান্ড মেসিদের প্রথম প্রতিপক্ষ।
পরেরদিন ব্রাজিল ‘হেক্সা’ (ষষ্ঠ) মিশনে নামবে। তুঙ্গস্পর্শী ফর্মে থাকা পেলে, জিকো, রোনালদো, রোমারিওর দেশের প্রথম ম্যাচ সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে। কোনো সন্দেহ নেই যে, গোটা বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাবে। হলুদ-সবুজ ও সাদা-নীল। এই চারটি রং ছাড়া আর আছে কী! ম্যারাডোনার জন্য আর্জেন্টিনা। মেসির জন্যও।
আর ব্রাজিল? শুধুই কী হলুদ রঙের জন্য? সেলেকাওদের যে ফুটবল ঐতিহ্য, পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার দুর্লভ নজির, বছরের পর বছর ধরে গারিঞ্চা, ভাভা, সক্রেটিসের মতো ক্ষণজন্মা ফুটবলারদের জন্ম দেয়া আমাজনের দেশের প্রতি ভালোলাগা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহমান।
দু’বারের বিশ্বকাপ মুকুটধারী আর্জেন্টিনার ফুটবল ঐতিহ্যও রীতিমতো ঈর্ষাজাগানিয়া। ম্যারাডোনার হাসি-কান্নায় বিহ্বল বাঙালি প্রথম আর্জেন্টিনার প্রেমে পড়ে। সেই আবেগ প্রবাহিত হয়েছে লিওনেল মেসির জাদুকরী নৈপুণ্যে।
মেসি তার পূর্বসূরির চেয়ে একটা দিক দিয়ে যে অনেক পিছিয়ে, এই বাস্তবতা জানার পরও নতুন প্রজন্ম ক্লাব ফুটবলের বদৌলতে মেসি বন্দনায় বিভোর। মেসির বিশ্বকাপ ট্রফি প্রাপ্য, খুব করে চাইছেন তারা। যেমনটি চাইছেন বিশ্বের অগুনতি আর্জেন্টিনাপ্রেমী। এটা জানার পরও যে, ফুটবল কারও একার খেলা নয়। এটি একটি দলীয় খেলা।
এখানেই আর্জেন্টিনার সঙ্গে ব্রাজিলের পার্থক্য, আর্জেন্টিনার আশা-ভরসা যেমন মেসি, তেমনি ব্রাজিলের স্বপ্নসারথি নেইমার। তা সত্ত্বেও বলতেই হয় যে, তিতের ব্রাজিল ও সাম্পাওলির আর্জেন্টিনা দলের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য, সেলেকাওরা সব বিভাগে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ যতটা শক্তিশালী, রক্ষণ ততটা নয়।
তার ওপর এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়দের দল আর্জেন্টিনা। তাদের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ৩০। ব্রাজিলকে বলা যায় একটা ‘টোটাল প্যাকেজ’। কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা- যারাই চ্যাম্পিয়ন হোক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ খুশি হবে। আবেগ একপাশে সরিয়ে বাস্তবতার জমিনে হাঁটলে বুঝবেন, এবার বিশ্বকাপ হচ্ছে রাশিয়ায়।
যেখানকার ঠাণ্ডা আবহাওয়া ভোগাতে পারে ইউরোপের বাইরের দলগুলোকে। শেষ তিনটি বিশ্বকাপ ট্রফি জিতেছে ইউরোপের তিন দেশ ইতালি (২০০৬), স্পেন (২০১০) ও জার্মানি (২০১৪)। ইউরোপীয়রা এবারও নিজেদের মহাদেশে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভীষণরকম আশাবাদী।
এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে নাম আসছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানির। তাদের সঙ্গে অনেকে জুড়ে দিচ্ছেন তারুণ্যে টগবগ করা ফ্রান্সের নাম। স্পেনও রয়েছে আলোচনায়। আর হ্যাজার্ড, লুকাকু, ডি ব্রুইনের বেলজিয়ামকে বলা হচ্ছে এবারের ‘ডার্কহর্স’। এবারের আসরে সবচেয়ে কম বয়সী (মাত্র ২৪ বছর) অধিনায়ক হ্যারি কেন ইংল্যান্ডের অনেকদূর যাওয়ার জন্য টিম স্পিরিটের ওপর জোর দিচ্ছেন।
ব্রাজিল শেষবার ট্রফি জিতেছে এশিয়ায়। ২০০২ জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ শেষবার জিতেছে ৩২ বছর আগে। এরপর শুধুই খরা। বলা হচ্ছে, এবারই মেসির শেষ সুযোগ।
মেসিও ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন, রাশিয়ায়ও যদি ট্রফি অধরা থাকে, তাহলে জাতীয় দলের হয়ে আর খেলবেন না। মেসির কষ্ট লাঘবের মিশন এবং নেইমারের দুঃখ ভোলার বিশ্বকাপ এটি। চার বছর আগে নিজেদের আঙিনায় দর্শক হয়ে নেইমারকে দেখতে হয়েছে জার্মানির কাছে সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের অসহনীয় হার। চোট থাকায় ওই ম্যাচে খেলা হয়নি তার। এবার তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে ব্রাজিলের স্বপ্ন। এখানেই মেসির সঙ্গে তার মিল।
এ জায়গায় যোজন মাইল পিছিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। মেসির তা-ও হিগুয়াইন, দিবালা, ডি মারিয়া আছেন, নেইমারের আছেন জেসুস, কুতিনহো, উইলিয়ান। রোনাল্ডোর কে আছে? তাই পর্তুগালের অনেকদূর যাওয়ার ওপর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে।
আবেগের জায়গা থেকে দেখলে, বাংলাদেশের ফুটবলভক্ত হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন মোহামেদ সালাহ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সের্গিও রামোসের ধাক্কায় কাঁধের ইনজুরিতে পড়ার পর তার কান্না বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
তাই মিসর বিশ্বকাপে কতদূর যাবে-না যাবে, সেই প্রশ্ন এখানে অবান্তর। শুধু বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশ, এশিয়াই নয়, ইউরোপের বাইরে সালাহর জন্য ফুটবলবুভুক্ষুদের মনের কোণে জমা হয়েছে অশেষ প্রেম। সেই প্রেমই এবার লিভারপুলের মিসরীয় ফরোয়ার্ডকে উচ্চাসনে আসীন করবে।
গত মঙ্গলবার মস্কোয় হয়ে গেল ভিক্টরি প্যারেড। রাশিয়া ডে। সেদেশের মাত্র তিন শতাংশ মানুষ নাকি জানেন দিনটার তাৎপর্য সম্পর্কে। কিন্তু রুশরা এটা ভালো করেই জানেন যে, বিশ্বকাপের গুরুত্ব কতখানি। তাই তারা দু’হাত প্রসারিত করে বিশ্বকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
এসো, এখানে এসো। উপভোগ কর বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফুটবলযজ্ঞ। পুতিনের জন্য এ আসর আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার পর রুশ প্রেসিডেন্ট পরিষ্কার ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘ফ্রম দ্য বটম অফ মাই হার্ট, থ্যাংক ইউ’।
রুশরা এখন গর্ব করে বলতেই পারে যে, বিশ্বকাপ শেষে বিশ্ববাসী ‘ধন্যবাদ’ জানাবে রাশিয়াকে। ১৫ জুলাই কার হাতে ট্রফি উঠবে, এই প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়। তার আগে যে পুতিনের বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে, একথা এখনই বলে দেয়া যায় অনায়াসে।