ক্রাইমবার্তা রিপোটঃএসএম শহীদুল ইসলাম: ২২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। তিনি শুধু বীরমুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি একজন সাবেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ১১দফা আন্দোলন, ৬৮’র গণআন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সরাসরি অস্ত্রহাতে যে ক’জন সাংসদ যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম স. ম. আলাউদ্দিন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হত্যাকা-ের সময় এবং বর্তমানেও তার দল রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তারপরও সেই মানুষটির হত্যার বিচার ২২ বছরেও সম্পন্ন হয়নি।
১৯ জুন ১৯৯৬ স. ম. আলাউদ্দিন খুন হন। ৫দিন পর মামলার অন্যতম আসামী কাজী সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার হন। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ি হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার করে অন্যান্য আসামীদের নাম ঠিকানাও প্রকাশ করে সাইফুল। ১১ মাস পর সিআইডি এই মামলার চার্জশীট দাখিল করেন। পরের বছর মামলার চার্জ গঠনের পর কয়েকজন আসামী উচ্চ আদালতে কোয়াশমেন্টের আবেদন করে। স্থগিত হয় মামলার বিচার কার্যক্রম। ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই মামলার প্রভাবশালী কয়েকজন আসামী সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামীদের শতাধিক আজ্ঞাবহ সন্ত্রাসী সাতক্ষীরা আদালতের বিচারকদের জিম্মি করে। দীর্ঘ ৬ ঘন্টা পর খুলনা ও যশোর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এলে সন্ত্রাসীরা সরে যায়। এর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সন্ত্রাসীদের সরিয়ে দিতে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সে সময়ের বিজ্ঞ দায়রা জজকে চাপ প্রয়োগ করেন আসামীদের জামিন দিতে। জেলা পুলিশও ওই শতাধিক সন্ত্রাসীকে সরিয়ে দিতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনার কিছুদিন পর চারজন আসামীর কোয়াশমেন্টের আবেদন মঞ্জুর করে উচ্চ আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ কোয়াশমেন্টের আদেশের বিরুদ্ধে এ্যাপিলেট ডিভিশনে আপিল করে। ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে এই মামলার কথা উল্লেখ না করেই বলেছিলেন, ‘আমার আইন পেশা ও বিচারিক জীবনে হত্যা মামলায় কোয়াশমেন্ট হয় তা কখনো দেখিনি।’ দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে ওই কোয়াশমেন্টের আদেশ খারিজ হয়। কিন্তু সেই আদেশ সাতক্ষীরা আদালতে পৌছাতে সময় লাগে কয়েক বছর। যদিও আদেশ পৌছালো, এবার আসামীরা গেলো আদালত পরিবর্তনের আর্জি নিয়ে হাইকোর্টে। সাতক্ষীরায় ন্যায় বিচার পাবেন না-কারণ দেখিয়ে তারা আবেদন করলো। দীর্ঘ শুনানী শেষে সে আবেদনও নামঞ্জুর হলো। আসামীরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে এবার গেলো এ্যাপিলেট ডিভিশনে। সেখানেও দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে আসামীদের আবেদন খারিজ হয়। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ১৫ বছর।
অবশেষে স্বাক্ষ্য শুরু হয় ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরপর কয়েকজনের স্বাক্ষ্য শেষ হলে নতুন করে শুরু হয় স্বাক্ষীদের প্রতি হুমকি-ধামকি। আদালত প্রাঙ্গনে নিহতের জ্যৈষ্ঠ কন্যাকেও প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হয়। এঘটনায় থানায় জিডি হয়। আদালতের নির্দেশে ওই জিডির তদন্ত হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তবে তাতে আসামীদের জামিন বাতিল হয়নি। ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার ৩৬ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের স্বাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। ৫/৭জন স্বাক্ষী মারা গেছে। ২/৩ জন রয়েছে দেশের বাইরে। আগামী ২৭ জুন মামলার পরবর্তী স্বাক্ষীর দিন রয়েছে। এভাবেই কেটে গেছে ২২টি বছর। মামলার প্রভাবশালী আসামী কুখ্যাত চোরাকারবারি গডফাদার ভূমিদস্যু সবুর তার সহযোগী আরেক গডফাদার খলিলুল্লাহ ঝড়–সহ তার ভাই কিসলু (মৃত), মোহন, নগরঘাটার রউফ, তার শ্যালক কালাম, এসকেন, সাইফুল, শফি ও আতিয়ারদের বিচার শেষ হতে আর কত বছর লাগবে তা এখনো অজানা।
দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক স. ম. আলাউদ্দিনের ২২তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ
এঘটনায় নিহতের ভাই স. ম. নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ১০মে সিআইডির খুলনা জোনের এএসপি খন্দকার ইকবাল হোসেন সাতক্ষীরার চিহ্নিত সন্ত্রাসী গডফাদারসহ ১০জনের নামে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। ১৪বছর আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করে কোয়াশমেন্ট এবং সাতক্ষীরায় ন্যায় বিচার না পাওয়ার কারণ দেখিয়ে অন্য জেলায় মামলাটির বিচারের আবেদন জানিয়ে আসামীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে বন্ধ ছিল। আইনী জটিলতা নিরসন শেষে ২০১২ সালে মামলাটির পুনরায় বিচার কাজ শুরু হয়। কিন্তু মামলাটির বিচার কাজ আজও শেষ হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম. আলাউদ্দিন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১০জন আসামির মধ্যে সাইফুল্লাহ কিসলুর অপমৃত্যু হয়েছে। আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি কিসলুর ম্যানেজার আসামি আতিয়ারকে। মামলায় সে পলাতক রয়েছে। মামলার অপর ৮জন আসামির মধ্যে কিসলুর ভাই সুলতানপুরের খলিলুল্লাহ ঝড়ু এবং আলিপুরের আব্দুস সবুর সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসী, চোরাকারবারী গড়ফাদার হিসেবে পরিচিত। ঝড়ু-কিসলুর আর এক ভাই সন্ত্রাসী মোমিন উল্লাহ মোহন, নগরঘাটার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, তার শ্যালক শহরের কামালনগরের সন্ত্রাসী আবুল কালাম, কিসলুর সহযোগী এসকেন্দার মির্জা, প্রাণসায়রের সফিউর রহমান এবং সুলতানপুরের কাজী সাইফুল ইসলাম (পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আহত) এই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় আসামি কাজী সাইফুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ভোমরা স্থলবন্দর, সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের বিরোধ, কলেজ ছাত্র ভবোরঞ্জন হত্যা মামলায় স. ম. আলাউদ্দিনের বাদী পক্ষে অবস্থান নেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে হত্যাকান্ডের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়। এ পর্যন্ত যে সব সাক্ষী হয়েছে সেই সব স্বাক্ষীদের জবানবন্দিতেও এগুলো স্থান পেয়েছে।
ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার ৩৬ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের স্বাক্ষী সম্পন্ন হয়েছে। ৫/৭জন স্বাক্ষী মারা গেছে। ২/৩ জন রয়েছে দেশের বাইরে। আগামী ২৭ জুন মামলার পরবর্তী স্বাক্ষীর দিন রয়েছে।