ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: বিএনপির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজপথে নামার অঙ্ক কষছে দলটির হাইকমান্ড। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নামার জন্য মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় আছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
তারা মনে করেন, বর্তমান সংকটের সমাধান হবেই। দলের মহাসচিব লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনা নিয়ে দেশে ফিরে সোমবার জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়।
সূত্র জানায়, হাতে সময় কম থাকায় জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটির চলমান কর্মসূচির ধরন পাল্টে যেতে পারে। রাজপথে কঠোর আন্দোলন ছাড়া এসব দাবির যৌক্তিক সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
কাজেই কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগে ছোট ছোট কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজপথে সক্রিয় হতে চান তারা। আর রাজপথে নামার আগে দল পুনর্গঠন ও বৃহত্তর ঐক্যের দিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের সঙ্গে শিগগিরই আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। এ ঐক্যকে নির্বাচনী ঐক্যে রূপান্তরের চিন্তাভাবনা রয়েছে তাদের।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলের করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নিতে সম্প্রতি লন্ডন যান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। আগামী দিনের করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা দেন তারেক রহমান। তারেক রহমানের বার্তা নিয়ে সোমবার বিকালে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরবলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সেই নির্বাচনে জনগণ যাদের ভোট দেবেন তারা সরকার গঠন করবে। কিন্তু বর্তমান সরকার জনগণের সেই ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে। তারা আবারও ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা একটি নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। কিন্তু এবার সেটা করতে দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, চেয়ারপারসনের মুক্তি এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে আমরা আন্দোলনের মধ্যেই আছি। এ দাবি আদায়ে আমরা বৃহত্তর ঐক্যের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, বর্তমান সংকট শুধু বিএনপির একার নয়। তাই সরকারবিরোধী প্রত্যেকটি দল, সংগঠন ও সচেতন জনগণ আমাদের এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবে বলে আশা করি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছু বিষয় দলের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। সেগুলো সবার সঙ্গে শেয়ার না করাই ভালো।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন, দল পুনর্গঠন, বৃহত্তর ঐক্য ও চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তারেক রহমান। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন তিনি।
স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে চেয়ারপারসনের যে নির্দেশনা রয়েছে সেই ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সেই ঐক্য যাতে নির্বাচনী ঐক্যে রূপ নেয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। এক নেতা জানান, আমরা নির্বাচনে অংশ নেব কি নেব না তা সময় বলে দেবে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
দলের নেতাকর্মী ও জনমতকে নির্বাচনের পথে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই পরিকল্পনাও নতুন করে সাজিয়ে নেয়া উচিত। তার এ পরামর্শের প্রতি প্রায় সবাই সমর্থন জানান। বৈঠকে দলের মহাসচিব জানান, এ মুহূর্তে আমাদের চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সেই নির্দেশনাই দিয়েছেন। তার মুক্তির ব্যাপারে সব পদ্ধতিই প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে রাজপথে কঠোর আন্দোলনে যেতে হলেও আমরা সেই সিদ্ধান্তই নেব।
বৈঠকে গাজীপুরসহ চার সিটি নির্বাচনের বিষয়েও আলোচনা হয়। বিশেষ করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে গুরুত্ব সহকারে নিতে সবাই পরামর্শ দেন। এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও কূটনৈতিকদের সহায়তা চাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়।
বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে দলীয় প্রার্থী প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। দ্রুত এসব সিটির নেতাদের ঢাকায় ডেকে তাদের পরামর্শ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দলটির নেতারা মনে করেন, আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ আটকে রেখেছে। এখন পর্যন্ত বিএনপি চরম ধৈর্যের সঙ্গে চেয়ারপারসনের বন্দি-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অগ্রসর হচ্ছে।
কিন্তু শুধু আইনি প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনের মুক্তি সম্ভব নয়। রাজপথেই এর সমাধান করতে হবে। এজন্য তার মুক্তির দাবিতে গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মসূচি দেয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। যা ধীরে ধীরে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে রূপ নেবে।
সূত্র জানায়, ঈদের আগে দলের পরবর্তী করণীয় নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতা ও তৃণমূলের মত নেয়া হয়। তারা প্রায় সবাই অভিন্ন অভিমত দিয়ে বলেছেন, বর্তমানে যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবিই আদায় করা যাবে না।
উল্টো সব স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়াসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হবে। এভাবে আন্দোলন না করে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে মাঠে নামার পক্ষে মত দেন তারা। রাজপথে নামার আগে সংগঠন গোছানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেন।
তাদের মতের ওপর ভিত্তি করেই দল পুনর্গঠনে হাত দেয়া হয়। রমজান মাসকে সাংগঠনিক মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৭৮টি জেলা শাখার মধ্যে যেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই তার একটি তালিকা করা হয়। এ তালিকা ধরে যেসব জেলা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ, সেখানে নতুন কমিটি এবং সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, আন্দোলনে সফলতা আনার লক্ষ্যে দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোসহ বৃহত্তর ঐক্যের দিকে নজর দিচ্ছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। পরবর্তী করণীয় নিয়ে জোটের শরিকদের মতামত নেয়া হবে।
পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন- এ ইস্যুতে সবাই একই প্ল্যাটফর্মে আসার চেষ্টা চালাবে। এ ঐক্যকে আগামী নির্বাচনী ঐক্যে রূপ দেয়া হবে এমন প্রতিশ্র“তিও থাকবে তাদের।
বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে বিভিন্ন দলকে ইফতার পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপিও ওইসব দলের ইফতারে যোগ দিয়েছে। বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রায় সবাই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। শিগগিরই তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করবেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এজন্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েক নেতাকে দায়িত্বও দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, এসবের পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে কূটনৈতিক তৎপরতাও। সম্প্রতি ভারত ঘুরে আসেন দলটির সিনিয়র কয়েক নেতা। তারা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। আগামীতে যাতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় সেজন্য শক্তিশালী দেশগুলো যাতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেই উদ্যোগ আরও বাড়ানো হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই বিএনপি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছে।
কিন্তু তৃণমূল থেকে কঠোর আন্দোলনের চাপ আসছে। তাই আন্দোলন কর্মসূচির ব্যাপারে দল ও জোট বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। জানতে চাইলে বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, তৃণমূলের দাবি সর্বাত্মক আন্দোলন করতে হবে। তিনি বলেন, আশা করি বিষয়টি হাইকমান্ডও অনুধাবন করতে পারছেন। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা করি।যুগান্তর