ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ একজন চিকিৎসকের প্রাইভেট কার চাপায় গুরুতর আহত সাতক্ষীরার টগবগে যুবক শাহীন কাদির (২২) টানা ১৯ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হেরে গেছে। আজ শুক্রবার বিকাল ৫ টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। গত ৩ জুন থেকে ১৯ দিনেও তার জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তাররা বলেন তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা ৭৫ ভাগ বিলুপ্ত হয়েছে। আঘাতজনিত কারনে মাথার ঘিলু নির্গত হয়েছে। কয়েকটি ¯œায়ু বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তপাত হয়েছে। মেরুদন্ডের উভয় স্কন্ধের হাড় ভেঙে গেছে। এছাড়া স্পাইনাল কর্ড ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। সারা শরীর থ্যাতলানো শাহীন কাদিরের লিভারও বড় হয়ে গেছে। সে অচেতন অবস্থায় বাকরুদ্ধ হয়েছিল।
তরতাজা এই যুবক সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের শ্রীফলকাটি গ্রামের এসএম মুজিবর রহমানের ছেলে। শাহিন সম্প্রতি কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের চেষ্টা করছিল। অপরদিকে প্রাইভেট কার চালক শ্যামনগর হাসপাতালের আরএমও ডা. আনিসুর রহমান একই উপজেলার হাওয়ালভাঙ্গি গ্রামের আবু দাউদ সরদারের ছেলে।
আহতের পারিবারিক সূত্র জানায় গত ৩ জুন শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. আনিসুর রহমান নিজে চালক না হয়েও বেপরোয়াভাবে নিজের প্রাইভেটকার চালিয়ে শ্যামনগর অভিমুখে আসছিলেন। অপরদিকে শাহিন কাদির তার বন্ধু হাবিবুর রহমানের মোটর সাইকেলে বসে বিপরীতমুখে কালিগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান শ্যামনগরের খানপুরে ফিলিং স্টেশনের কাছে একটি ছোট কালভার্টের ওপর তার প্রাইভেট কারটি শাহিন কাদিরকে চাপা দেয়। তাকে গুরুতর আহত দেখেও চালক ডা. আনিস সরাসরি শ্যামনগরের দিকে পালিয়ে যান। গ্রামবাসী এ সময় তাকে তাড়া করেও ধরতে ব্যর্থ হন। স্থানীয়রা শাহীন কাদিরকে শ্যামনগর হাসপাতালে ভর্তি করলেও ডা. আনিস তার চিকিৎসায় সাহায্য করা এমনকি তার সামনেও আসতে অস্বীকৃতি জানান। শাহীন কাদিরের বাবা এসএম মুজিবুর রহমান জানান, তার ছেলেকে শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরায় পরে খুলনা এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শুরুর আগে ডা. আনিস তাকে বলেছিলেন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিতে। চিকিৎসার সব খরচ তিনি বহন করবেন। অভিযোগ করে মুজিবুর রহমান আরও বলেন খরচ বহন করা দুরের কথা বরং চিকিৎসার ব্যাপারে কোন সহায়তা করার আশ্বাসও তিনি দেননি। এলাকাবাসী জানান, ডা. আনিসের মালিকানাধীন সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি (রেজি নং- ঢাকা মেট্রো -গ- ৩৫-১২১১) তিনি নিজে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আনাড়ি চালক হওয়ায় তার গাড়িতে থাকা জনৈক সোহরাব মোড়ল তাকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষন দিচ্ছিলেন। এসময় গাড়ির মধ্যে উচ্চস্বরে কথোপকথন, হাসিঠাট্টা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাবে কথা বলছিলেন তারা। তাদের খামখেয়ালির কারনে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান এলাকাবাসী।
শাহীন কাদিরের বাবা এসএম মুজিবুর রহমানের অভিযোগ ডা. আনিসুর রহমান তার ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। চিকিৎসার শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এসব টাকা তিনি জমি বিক্রি ও বন্ধক এবং সমিতি থেকে লোন নিয়ে পরিশোধ করেছেন। মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে এসে বাবা মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোঃ নাসিমের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, ‘আমি আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য আপনাদের কাছ থেকে মানবিক সহায়তা চাই’।
এদিকে নিজের গাড়ি চাপায় দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানতে চেয়ে ডা. আনিসুর রহমানের কাছে টেলিফোন করা হলে তিনি দাবি করেন, ওইদিন তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন না। তার ড্রাইভার সোহরাব মোড়ল গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি রোগীর জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন। শ্যামনগরের অনেক সংবাদকর্মী এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারি এবং সাধারন নাগরিকরা জানান ডা. আনিসুর রহমান মাদকাসক্ত এবং তিনি নিয়মিত ইয়াবা খেয়ে থাকেন। এ কারণে তার হাতে কোনো রোগী নিরাপদ নন দাবি করে তারা বলেন তাকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। তার হাতে বহু রোগী মারা গেছে। তার দাপটে শ্যামনগর হাসপাতালে কোনো ভালো ডাক্তার টিকতে পারছেন না বলেও জানান তারা। তবে ডা. আনিস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি মাদকাসক্ত নন বলেও দাবি করেন।
এদিকে প্রাইভেট কার চাপায় গুরুতর আহত হবার পরও শ্যামনগর থানা পুলিশ শাহিনের বাবার দেওয়া মামলা গ্রহন করে নি। এলাকাবাসী জানান ওসির সাথে ডাক্তার আনিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওসি তার গাড়ি বিভিন্ন সময় ব্যবহারও করে থাকেন। পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকার করায় বাবা এসএম মুজিবর রহমান সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সহযোগিতা কামনা করে আবেদন করেছেন। জানতে চাইলে শ্যামনগর থানার ওসি সৈয়দ মান্নান আলি বলেন তারা কোনো এজাহার দেননি। এজাহার দেওয়ার কথা বারবার বলা হয়েছে। এখনই এজাহার দিলে তিনি তা রেকর্ড করবেন বলেও জানান।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দুর্ঘটনায় নিহত শাহীন কাদিরের বাবা মুজিবর রহমান ডা. আনিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়েছেন।