আঙ্কারা থেকে হাফিজুর রহমান: নাতি নাতনি ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইস্তানবুলের একটি কেন্দ্রে ভোট দিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান…!!
আজ রোববার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচন কোনদিকে যাচ্ছে কিংবা ফলাফল কি হতে পারে এটা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আছে নানা জরিপ, ভবিষ্যৎবাণী তথা সম্ভাব্যতা এবং নানামুখী পর্যালোচনা। স্বভাবতই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রীতিমত গরম চা-আড্ডাগুলো।
নানা কারণে নির্বাচনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ নতুন সরকার পদ্ধতিতে যাবে। আছে ২০২৩ সালকে কেন্দ্র করে নানামুখী চিন্তা, আছে বিশ্বরাজনীতির নানা কলকাঠি। এ সব মিলিয়ে রোববার তুরস্কের জনগণ আগামী পাঁচ বছরের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটে যাচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে সুযোগ হয়েছে মাঠ পর্যায়ে যাওয়ার, সুযোগ হয়েছে রাজনীতিবীদ, একাডেমিশিয়ান এবং ব্যবসায়ী থেকে শুরু একদম সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কথা বলার। এ সব মিলে নির্বাচনের সম্ভাব্য গতি নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি গত দুই মাস। তার ছোট্র একটা ব্রিফিং নিম্নে দেয়া হলো
নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল বর্ণনা করার আগে আপনাদের একটু স্বরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এই নির্বাচনে মূলত দু’টি জোট ও একটি দল তপ্রতিদ্বন্দি¦তা করছে। জোটগুলোর মধ্যেÑ
প্রথমত: একে পার্টির নেতৃত্বে ডান দলগুলোর জোট যাতে একে পার্টির পাশাপাশি আছে তুরস্কের মূলধারার জাতীয়তাবাদী দল মেহেপে/এমএইচপি ও আরেক জাতীয়তাবাদী দল বিবিপি।
দ্বিতীয়ত: সেক্যুলার জেহেপে/সিএইচপির নেতৃত্বে বাম ও মিশ্র জোট। এতে আতাতুর্কের জেহেপে/সিএইচপি, জাতীযতাবাদী দল থেকে ভেঙ্গে গড়া নতুন দল ইয়ি পার্টি, ইসলামপন্থী দল সাদেত পার্টি এবং ডানপন্থী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
আর কুর্দীদের দল হেদেপে/এইচডিপি এককভাবে নির্বাচন করছে। এছাড়া বাকী যে ছোট ছোট দলগুলো এককভাবে নির্বাচন করছে তারা মূলত অস্তিত্বহীন দল যাদের একদমই ভিত্তি নেই।
নির্বাচনে বেশ কয়েকটা দিক উল্লেখ করা যায়:
১. “সময় এখন তুরস্কের” এবং “করলে একে পার্টিই করবে” এই স্লোগানে নির্বাচন পরিচালনা করছে একে পার্টি। তাদের প্রচারণায় বিগত ১৬ বছরের সফলতা এবং আগামীর পরিকল্পনা তুলে ধরছেন।
২. বিরোধী জোট ও কুর্দীদের দলের সম্মিলিত আওয়াজ, ‘পরিবর্তন’। তাদের মূল টার্গেট এরদোগানকে সরানো। সেটা যেকোনভাবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, সারাজীবন কুর্দীদের মাইর দেয়া আতাতুর্কের দলসহ সকল বিরোধী দল এবার কুর্দীদের সন্ত্রাসী গোষ্টী পেকেকে এবং কুর্দীদের দলের পক্ষে কথা বলছে। যেটা তুরস্কের রাজনীতিতে রীতিমত অশনি সঙ্কেত।
৩. বিরোধী জোট নির্বাচনে জয়ী হলে তুরস্ককে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে তারচেয়ে এরদোগানের বড় বড় সবগুলো প্রজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া নিয়েই মুল প্রচারণা চালাচ্ছে।
ফলাফল কেমন হতে পারে। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে তাতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রথম রাউন্ডেই জয় পেয়ে যেতে পারেন। যদিও এটা খুব সহজ কাজ নয়। কারন ৫০+১ টি ভোট পেলেই বর্তমান পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব। তবে সকল জরিপ বলছে পার্লামেন্টে একে পার্টির ভোট তথা আসন কমবে। যদিও এখন সরকার গঠন করতে পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্টতার প্রয়োজন নেই। কারণ নির্বাহী ক্ষমতা তথা সরকার গঠন করা ও দেশ চালানোর ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। তবে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্টতা না পেলে আইন পাশ করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে কনভিন্স করে নিতে হবে যাতে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অনেক আইনের। সবমিলে নির্বাচনের ফলাফলটা এই ধরনের হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন:১ রজপ তায়্যিপ এরদোগান (সরকারি জোট): ৫০-৫২% মোহাররেম ইনজে (সিএইচপি): ২৩-২৮% মেরেল আকসেনার (ইয়ি পার্টি): ৮-১০% সালাহউদ্দিন ডেমিরতাস (কুর্দীদের দল): ৮-১০% তেমেলে কারামুল্লাহওলু (সাদেত পার্টি): ১-২%
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরেকজন প্রার্থী আছেন তার ভোট প্রাপ্তির সম্ভাবনা কয়েক হাজারের মত (০.১০% বা তারচেয়ে কম)। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রত্যেক দলই আলাদাভাবে প্রার্থী দিয়েছে।
*পার্লামেন্ট নির্বাচন:
– সরকারী জোট: ৪৭-৫০% একে পার্টি: ৪০-৪৫% (বিবিপির প্রার্থীরা একে পার্টি থেকে নির্বাচন করছে। একে পার্টি তাদেরকে ১৮ টি আসনে ছাড় দিয়েছে)
২. মেহেপে/এমএইচপি: ৭-৮%
– বিরোধী জোট: ৩৫-৪০% সিএইচপি/জেহেপে: ২৫-২৬% ইয়ি পার্টি: ৮-১০% (ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীরা তাদের সাথে নির্বাচন করছে)
৩. সাদেত পার্টি ১-২%
উল্লেখ্য, বিরোধী জোটের মধ্যে সাদেত পার্টি সব আসনে প্রার্থী দিলেও সিএইচপির হয়ে ৬ জন (৬ টি আসন) প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। অর্থাৎ সিএইচপি সাদেত পার্টিকে ৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে। যদিও বিষয়টাকে অস্বীকার করে সাদেত পার্টি।
– কুর্দীদের দল: ৮-১১%
– অন্যান্য ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীবৃন্দ: ১%
নির্বাচনে দুটির যেকোন একটি সারপ্রাইজ থাকতে পারে। প্রথমটা সরকারি জোটের জন্য পজেটিভ আর দ্বিতীয়ত নেগেটিভ।
১. তুরস্কের সিস্টেম অনুযায়ী কোনো দল ১০% ভোট না পেলে পার্লামেন্টে কোনো আসন পাবেনা। তবে সেটা জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। কেননা জোট যদি ১০% এর বেশি ভোট পায় তবে জোটভুক্ত সকল দলই ১০% এর উপরে পেয়েছে বলে গণ্য হবে। আচ্ছা, এবার আসি মূল কথায়। এবারের নির্বাচনে কুর্দীদের দল যদি ১০% ভোট না পায় তাহলে এটা বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ হতে পারে। সেক্ষেত্রে কুর্দী অঞ্চলের প্রায় সকল আসনই একে পার্টি পাবে। কারণ সে জেলাগুলোতে কুর্দী দল ছাড়া শুধু একে পার্টিই উল্লেখযোগ্য ভোট পায়। এরকমটি ঘটলে সরকারি জোটের আসনসংখ্যা বেশ বেড়ে যাবে। উল্লেখ্য, পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্টতা পাওয়ার জন্য ৩০১টি আসন দরকার (মোট আসন ৬০০ টি)।
২. যদি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এরদোগান ৫০%+১ টি ভোট না পান তবে এটা হতে পারে দ্বিতীয় সারপ্রাইজ। অর্থাৎ এরদোগান যদি ৪৯.৯৯% এমনকি ৫০% ভোটও পান সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে যেতে হবে যেটা অনুষ্ঠিত হবে ৮ জুলাই।
সবমিলে এই নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফলাফল হবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান যদি প্রথম রাউন্ডে জয় পান এবং সরকারি জোট সংসদে মোটামুটি একটা সংখ্যাগরিষ্টতা পায়। তাতে তুরস্কের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকবে। নয়তো বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিরোধী দলগুলোর বক্তব্যের সারমর্মটা এমন, এরদোগান যাক, এরপর যেই আসুক সমস্যা নাই এতে দেশের ক্ষতি হলেও কিছু যায় আসেনা। তারই অংশ হিসেবে আদর্শের বিন্দুমাত্র মিল না থাকার পরও জোটবদ্ধ হয়েছে বিরোধী দলগুলো।
এই নির্বাচনে গুলেনপন্থী ভোটগুলো যাবে ইয়ি পার্টিতে যা বিরোধী জোটকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নিবে। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতেও ইয়ি পার্টি ও তার প্রধানকে বেশ হাইলাইট করা হচ্ছে। অন্যদিকে কুর্দীদের দল যাতে ১০% এর ওপরে ভোট পায় তা নিশ্চিত করতে বিরোধী জোট ব্যাপক চেষ্টা করছে। প্রয়োজনে নিজেরা ভোট দিয়ে হলেও তারা কুর্দীদের দলটিকে পার্লামেন্টে ঢুকাতে চায়।
নির্বাচনের ফলাফল কি হবে তা নিয়ে অনেক ভবিষ্যৎবাণী করা যায় কিন্তু শেষ কথা বলবেন ভোটাররা। তুরস্কের জনগণ কি চাচ্ছেন সেটাই মুখ্য। আগামী একদিন পরেই সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান হবে।