গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার বা হয়রানি না করার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল রোববার গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে এসে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সকল দল এবং প্রার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ, পুলিশ বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার-হয়রানিসহ কতিপয় অভিযোগ উত্থাপন করেন। সেগুলোর প্রতিকারের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশন বরাবর একটি আবেদন করেছেন’।
‘উল্লেখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার না করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। এ অবস্থায় নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোনো বাসিন্দা বা কোনো ভোটারকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার না করার জন্য অনুরোধ করা হল।’
গাজীপুর সিটিতে ৫৭টি সাধারণ এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। এ সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ জন। এরমধ্যে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৫ জন পুরুষ এবং ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন নারী ভোটার। নির্বাচনে সাতজন মেয়র, ৮৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতারের অভিযোগ
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের এক দিন আগে নগরজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রধান এজেন্ট ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো: সোহরাব উদ্দিন সোমবার দুপুরে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কাছে এ সংক্রান্ত দুটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
তিনি জানান, পুলিশের অভিযানের মুখে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীসহ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোববার রাতে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার সাথে জড়িত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের কারোর বিরুদ্ধেই কোন মামলা নেই।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. মাজহারুল আলম জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সকল অঞ্চলে ২০ দলীয় জোটের সকল নেতাকর্মী ও সমর্থকের বাসা-বাড়িতে পুলিশ প্রতিদিনই হানা দিচ্ছে। বিশেষ করে ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী-সমর্থকদের তালিকা ধরে টার্গেট গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। এতে নেতাকর্মীরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। লাগাতার পুলিশী হামলা ও হয়রানিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বিএনপি তথা ২০দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের অসহায় পরিবার।
গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবারের উদ্ধৃতি দিয়ে ধানের শীষের মিডিয়া সেল জানায়, পুলিশ নেতাকর্মীদের বাড়ির গেট ও দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে গ্রেফতার করছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা নাই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার আসামী হলেও বর্তমানে জামিনে আছেন। পুলিশের গ্রেফতার অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, যাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কোন মামলা ছিল না তাদেরকে ধরে ভিন্ন জেলা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। দুই/তিন দিন পর কাউকে টাঙ্গাইল, কাউকে নারায়ণগঞ্জ ও কাউকে ঢাকার জেলখানায় পাওয়া যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেককে অন্য জেলার একাধিক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে দেয়া হচ্ছে। ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের এই গ্রেফতার অভিযানে গাজীপুর ডিবি পুলিশের সাথে জেলার সকল থানা ও পাশর্^বর্তী জেলা সমূহের পুলিশ নামোনো হয়েছে। ২৪-০৬-১৮ রাতে ডিবি পুলিশ ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ১৮ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের কারোর অবস্থান এখনো জানানো হচ্ছে না।
ধানের শীষের মিডিয়া সেল কর্তৃক দেয়া তথ্য মতে গ্রেফতারকৃতরা হলো, কোনাবাড়ি ১১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সবুজ, ৩১ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি আহব্বায়ক বিডি আর অব. মজিবুর রহমান, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্য ও নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্য কবির হোসেন, আব্দুল মান্নান, কাউলতিয়া ২৪ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্য জৈনুদ্দিন মোড়ল, পূর্ব ধীরাশ্রম ২৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি কর্মী হেলেন বাদশা, পশ্চিম ধীরাশ্রম বিএনপিকর্মী আলমগীর, ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্র পরিচালনা কমিটি আহব্বায়ক মোশারফ হেসেন বাদশা, ২৯ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মজিবর রহমান, টঙ্গীর মু;দাফা ৫২ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সদস্য মো: ইউনুস মিয়া, গাছা কলমেশ^র আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য লিটন মোল্লা গিয়াস, কাউলতিয়া পোড়াবাড়ির ২৩ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য হারিস, বাউরাইদের সাবেক কাউলতিয়া ইউপি ছাত্রদল সভাপতি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য বাকির হোসেন, কানাইয়া গ্রামের ৩০ ওয়ার্র্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যর শোভা ও আব্দুর রহমান।
এছাড়া পুলিশ রোববার দিবাগত রাতে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বাঙ্গালগাছ এলাকায় বিএনপির নির্বাচনী অফিসের কেয়ারটেকার শামীমকে বেধড়ক পিটিয়েছে, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছাত্রদল নেতা ইমতিয়াজ আলম খান তুষারকে বাসায় না পেয়ে তার বৃদ্ধ পিতা আলম খানকে মারধর করেছে। এছাড়া বাসন ইউনিটের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব, বিএনপির সদর থানা সাংগঠনিক সম্পাদক বশির আহমেদ বাচ্চু, কাউলতিয়া নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সালনায় বিএনপি নেতা হারুন, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের নান্দুয়াইলে শরিফ, খলিল মেম্বার, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক রয়েল হায়দার, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল নেতা জুয়েল মন্ডল, পূবাইল অঞ্চল নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও পূবাইল যুবদলের সভাপতি মজিবুর রহমান, পূবাইল ছাত্রদল সভাপতি নজরুল ইসলাম, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে গাছা যুবদলের সহসভাপতি মোশারফ মন্ডল, ১০ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্র কমিটির সদস্য সচিব মিলনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর বাড়িতে রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে ভাংচুর করে পুলিশ। এসময় তাদেরকে বাসায় না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে।
এর আগে শনিবার রাতে পুলিশ চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বাসন অঞ্চল ধানের শীষের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সাবেক বাসন ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন চৌধুরীর বাড়ির গেটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে। এসময় তাকে না পেয়ে দারোয়ান ও পরিবারের সদস্যদের কাছে পুলিশ এই বলে হুমকি দিয়ে যায় যে, ‘ আগামীকাল জাহাঙ্গীরের সাথে তাকে (আলাউদ্দিনকে) দেখা করতে বলবি, দেখা না করলে তার পরিণতি খারাব হবে। আর যদি দেখা না করে তাহলে ঘর থেকে যেন বের না হয়’।
টঙ্গী থানা স্বেচ্ছাসেবকদলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ভেন্ডার ও মহানগর ছাত্রদল নেতা সিরাজুল ইসলাম সাথীর বাসায় ২৩ জুন রাতে হানা দেয় ডিবি ও থানা পুলিশ। পুলিশ নেতাকর্মীদের বাসায় না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে যায়, নির্বাচনের আগে যেন এলাকায় না আসে। পুলিশের এই অভিযানে যুক্ত হয়েছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী। সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাইরে পাশের এলাকাসমূহের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত করা হয়েছে অভিযান পরিচালনা কমিটি। তারা পুলিশের সাথে মুখোশ পড়ে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বাসা বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এছাড়া আওয়ামীলীগ ক্যাডাররা ধানের শীষের সব পোস্টার ছিরে ফেলছে।
রোববার রাতে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড এরশাদ নগর এলাকায় ও গাছা অঞ্চলে ধানের শীষ প্রতীকের অধিকাংশ পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গত ২০ জুন প্রার্থীদের ডেকে মতবিনিময় সভায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোন বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, নির্বাচন অবাধ না হলে বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিনষ্ট হলে যারা দায়ী থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ২০ দলীয় জোট মেয়রপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে বার বার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
পাইকারি হারে গ্রেফতার চলছে : রিজভী
গাজীপুর সিটিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। সেইসাথে বেগম খালেদা জিয়ার জামিন না দিতেও সরকার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ করছে বলে দলটির অভিযোগ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আজ সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা থেকে সরে যেতে পছন্দ করে না। এজন্য রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দখলে রাখা প্রয়োজন মনে করে। সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দলীয় চেতনার লোক নিয়োগ দিয়ে কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের কাজটি সম্পন্ন করেছে আওয়ামী সরকার।
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন- ‘সিটি নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ম্যাসেজ নেই’। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তিটিতে সেই প্রবাদটি মনে পড়ে- ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনি।’ অথচ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সর্বত্র সরকারের ম্যাসেজ প্রতিপালিত হচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে। প্রতিটি লোকালয়ে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরীর কাজ খুব সুচারুভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। পাইকারী হারে গ্রেফতার, বাসায় বাসায় তল্লাশী, বিভিন্ন কেন্দ্রে ধানের শীষের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দকে আটক, নতুন করে মিথ্যা মামলায় হয়রানি, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়ে আসা ডিবি পুলিশের হানাদারি আগ্রাসন, সরকারি দলের মেয়র, মন্ত্রী ও নেতাদের নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গসহ সর্বোপরি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পুলিশের গাড়িতে করে প্রচারাভিযান ইত্যাদি ঘটনায় সরকারের ম্যাসেজটা কী তা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোটারদের বুঝতে বাকি নেই।
রিজভী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন না দিতেও সরকার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ করছে। আইনগতভাবে জামিন পাবার অধিকারী হলেও দেশনেত্রীকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আদালতে প্রমাণিত হয়নি। যে মামলায় নিম্ন আদালত তাকে সাজা দিয়েছে তা মিথ্যা, বানোয়াট এবং সরকার প্রধানের ইচ্ছা পূরণের রায়।
তার অন্যান্য মামলায় অনেকেই ইতোমধ্যে জামিন পেয়েছেন। আইনগতভাবে বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাবার অধিকারী হলেও তাকে জামিন না দেয়াটা সরকারের চোখ রাঙানির বহিঃপ্রকাশ। কেনো তিনি জামিন পাচ্ছেন না? দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেত্রীকে এভাবে বন্দী করে শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট দেয়া সরকারের জন্য আনন্দের বিষয় হলেও দেশের জনগণ সর্বোচ্চ আদালতের কাছে সুবিচার প্রত্যাশী।
যেসব মামলায় অন্য মানুষের জন্য বিচারে যে প্রতিকার দেয়া হয়েছে, একই মামলায় দেশনেত্রীর প্রতি ভিন্ন বিচার, ভিন্ন আচরণ দেশের জনসাধারণকে ব্যথিত করছে। উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলেও যদি ফাটল ধরে তাহলে গোটা দেশে নৈরাজ্য নেমে আসবে। সমাজ অরাজকতার অন্ধকারে ঢেকে যাবে। প্রতিহিংসা একধরনের বন্য বিচার। আদালত যদি সরকারের প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের যন্ত্রে পরিণত হয় তাহলে দেশের জনগণ স্বৈরাচারী সরকারের ক্রীতদাসে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, সরকারের হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নিম্ন আদালত যদি ন্যায়বিচার করতো তাহলে তাকে সরকারের বিদ্বেষের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দী অবস্থায় নির্মম যন্ত্রণার মধ্যে বসবাস করতে হতো না। বিনা চিকিৎসায় দেশনেত্রীকে কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হতো না। সরকারের নির্দেশেই নি¤œ আদালত বেগম জিয়াকে কষ্ট দিতেই অন্যায়ভাবে সাজা দিয়েছে। যাতে সরকার দেশনেত্রীর জীবনকে নানাভাবে সংকটাপন্ন করতে সুযোগ পায়। বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ থাকুন সেটা সরকার চায় না বলেই তাদের হাতের মুঠোয় রাখতে নি¤œ আদালতকে ব্যবহার করেছে। এজন্য কারাগারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলেও সরকারের অংশ কারা কর্তৃপক্ষ দেশনেত্রীর কোনো খবর রাখেনি। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য এতবার বলার পরও তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। জরুরী ভিত্তিতে সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। তার অসুস্থতা দিনকে দিন গুরুতর অবস্থার দিকে যাচ্ছে। আর বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে আওয়ামী নেতারা বিকৃত বিবৃতি দিচ্ছেন এবং অনাবশ্যক কটূকথা বলেই যাচ্ছেন। আমরা আবারও দ্বিধাহীন কন্ঠে বলতে চাই- দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি ও সুচিৎিসার ব্যবস্থা করা হোক। অন্যথায় সরকারের অন্যায়ের কড়ায় গন্ডায় হিসাব জনগণ আদায় করে নিবে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, কয়েক দিন আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, গাজীপুরে খুলনার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তার মানে খুলনায় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট সন্ত্রাসের যে অভিযোগ করা হয়েছে তার বক্তব্যে সেটিই প্রমাণিত হলো। এবং এই ভোট কারচুপি ও অনিয়ম কমিশন ঠেকাতে পারেনি। এদিকে শুধু খুলনামার্কা নয়, গাজীপুরে ভোট ডাকাতির সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়তে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ইসি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
তিনি বলেন, আগামীকাল গাজীপুর সিটি করপোরেশনে যে ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেখানে জনগণ অবাধে পছন্দানুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে এমন কোনো পরিবেশ এখনো দৃশ্যমান নয়। জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা আরো গভীরতর হচ্ছে। গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখন পর্যন্ত যতটুকু খবর আমাদের নিকট এসেছে তাতে গাজীপুরে বাছাই করে করে দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের বিশ^াস সকল বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবেন। ভোট যদি কিছুটা সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তাহলে ধানের শীষের বিজয় ঠেকাতে পারবে না।
রিজভী বলেন, গত রোববার রাতে গাজীপুরে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতসহ ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ১১ নং ওয়ার্ডে সাইফুল ইসলাম সবুজ, ৪৭ নং ওয়ার্ডে আমজাদ হোসেন জনি, ৩১ নং ওয়ার্ডে মজিবুর রহমান, ৩২ নং ওয়ার্ডে আনোয়ার হোসেন, ইউসুফ হোসেন, কবির হোসেন, আব্দুল মান্নান, ২৪ নং ওয়ার্ডে জয়নুদ্দিন মোড়ল, ২৯ নং ওয়ার্ডে মজিবুর রহমান, ৫২ নং ওয়ার্ডে মো: ইউনুস, লিটন মোল্লা, সেলিম রেজা, হেলেন প্রমুখ। এছাড়াও গতরাতে শত শত বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়ীতে বাড়িতে হানা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার করা হয়েছে এখন পর্যন্ত দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে। আমি অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
তিনি আরো জানান, বরিশাল উত্তর জেলাধীন আগৈলঝড়া উপজেলার বৈলা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী হেমায়েত তালুকদার গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয় নাই। ফেনীর সোনাগাজী পৌর বিএনপি সভাপতি আবু মোবারক দুলালকে গতরাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোকাদ্দেম হোসেন সজলকে গতকাল পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বান্দরবান জেলা বিএনপির সভাপতি মিসেস মা ম্যা চিং এবং সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজাসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে।
রিজভী বলেন, জাতীয়তাবাদী দল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বংশাল থানাধীন ৩৩ নং ওয়ার্ডের সভাপতি এরশাদ আলী লাডলা (৩৮) নিজ এলাকায় একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। তাকে গতবছরের ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচি পালনকালে শান্তিনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে রিমান্ডে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালায় পুলিশ। কারাগারে বেশ কয়েকবার অসুস্থ হলেও কারা কর্র্তৃপক্ষ তাকে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কয়েকদিন আগে কারাগারে অজ্ঞান হয়ে পরে যাওয়ার পর অচেতন অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে মেঝেতে ফেলে রাখে। গত ২১ জুন আদালত থেকে তার জামিনের আদেশ কারাগারে পৌঁছালে তিনি মুক্ত হন। ততক্ষণে হাসপাতালে তার জীবন প্রদীপ নিবু নিবু। পরবর্তীতে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে বাঁচাতে হাসপাতালে ভর্তি করলেও গত পরশু রাত ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি এ অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এরশাদ আলী লাডলা’র অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।