ক্রাইমবার্তা রিপোট: গাজীপুরের নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। মঙ্গলবার রাত আড়াইটায় বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ৩৪৫টি কেন্দ্রে তিনি ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৩৯ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী মো. হাসান উদ্দিন সরকারের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৪ ভোট পেয়েছেন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান সরকার ধানের শীষ প্রতীকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৫৫ ভোট পেয়েছেন।
এর আগে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির অধ্যাপক এমএ মান্নান। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৪২৫টি ভোট কেন্দ্রে একযোগে ভোট গ্রহণ করা হয়। বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
এ সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৭৩৬ জন। এর মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে আশা করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী হলেও মূল লড়াই হয় নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকে।
এদিকে গত রাত ২টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল ২০৫ কেন্দ্রের বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন। তখন পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলম ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৪ ভোট এবং হাসান সরকার ৯৯ হাজার ৪৭৮ ভোট পেয়েছেন। এ ছাড়া মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বাকি পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুর রহমান (মিনার) পেয়েছেন ৭৫৫ ভোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. নাসির উদ্দিন (হাতপাখা) পেয়েছেন ১৩৮৪, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন (মোমবাতি) পেয়েছেন ১২০২, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাজী মো. রুহুল আমিন (কাস্তে) পেয়েছেন ৩৮১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ (টেবিল ঘড়ি) পেয়েছেন ৮৫৬ ভোট পেয়েছেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাজীপুরকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, আমি শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কথা মাথায় রেখে এ নগরীকে গড়ে তুলব। আশা করি, গাজীপুরসহ দেশবাসী আমাকে সহযোগিতা করবেন।
মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টায় বিজয়ের প্রাক্কালে প্রতিক্রিয়ায় গাজীপুরের নিজ বাসায় তিনি গণমাধ্যমকে এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলম যখন গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিলেন ঠিক সে মুহূর্তে কয়েক হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থক তার বাসার নিচে উল্লাসে মেতে ওঠেন। অনেকে ফুলের তোড়া, ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, এ শহর সবার। আজকের এ বিজয়ের আনন্দ আমি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। সবাই আমার সঙ্গেই থাকবেন প্রত্যাশা করি।
গাজীপুর নিয়ে মহাপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি একটি প্যাকেজ তৈরি করেছি। যানজট নিরসন, গার্মেন্ট শিল্পের আধুনিকায়ন, জলজট নিরসনে তুরাগ নদ খনন, বেকার সমস্যার সমাধানসহ ভোটারদের কাছে প্রতিশ্র“ত মহাপরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তা দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ করবেন বলেও জানান নবনির্বাচিত এ মেয়র।
গাজীপুরকে তরুণ প্রজন্মের বাসযোগ্য আধুনিক শহর গড়ে তুলবেন উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ শহরে যাতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে বসবাস করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমি কাজ করব।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে প্রতীয়মান হচ্ছে আমি নির্বাচিত হতে যাচ্ছি। এখন অপেক্ষা আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের। গাজীপুর শহর নিয়ে আমার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা আছে। আমি সেই পরিকল্পনামতো কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, নাগরিক সেবা বিশেষ করে হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বাসস্থানসহ ভোটারদের সমস্যা ও তাদের সুবিধা আমার কাছে অগ্রাধিকার পাবে।
তরুণদের অনেকেই সামনে এগিয়ে যেতে দেয় না কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, তিনি তরুণদের অগ্রাধিকার দেন। আমিও তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করব।
এর আগে ভোট গণনার সময়ে রাত ১১টার দিকে তিনি বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। এ সময় তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিজয়ী করায় গাজীপুরবাসীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান সরকারের উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, উনার স্বাস্থ্যগত উন্নতির জন্য দোয়া করি। আমি তাকে বলব, না জেনে-বুঝে মিথ্যাচার করবেন না। উনি প্রথম থেকেই একের পর এক অভিযোগ করে আসছেন। ওনার কাছে আমি সহযোগিতা চাইব। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও ভালো প্রার্থীর জয় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
হাসান সরকারের প্রতিক্রিয়া : মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টঙ্গীতে নিজ বাসায় হাসান উদ্দিন সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪শ’রও বেশি কেন্দ্রের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। প্রথমেই বেলা ১১টার মধ্যে শতাধিক কেন্দ্রের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। দুপুর ২টায় রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর রেখে এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। ভোর থেকেই পুলিশ সাদা পোশাকে বিভিন্ন কেন্দ্রের পাশে ওতপেতে থাকে। তারা আমাদের এজেন্ট ও দায়িত্বশীল নেতাদের গ্রেফতার করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের ২০ জন এজেন্ট ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা একাধিকবার এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢোকানোর চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই আমাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। আমরা জনগণকে কথা দিয়েছিলাম নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব। প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে সিল মারার পরও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার উদ্দেশ্য হল, এ সরকারের চরিত্রটুকু উন্মোচন করে দেয়া। নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগের চরিত্রটা ভালো করে জানল। কোনো রক্তপাত ও প্রাণহানি না ঘটায় এবং ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা কষ্ট স্বীকার করায় তিনি দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
হাসান সরকার বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের আন্দোলন চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইরে থেকে ব্যালটে সিল মেরে ভেতরে এনে বাক্সে ভরা হয়েছে। এ নতুন প্রজন্মও জানল আওয়ামী লীগের চরিত্রটা কেমন। কেন্দ্র দখলকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে ধৈর্যধারণ করায় তিনি সব নেতাকর্মী ও এজেন্টকেও ধন্যবাদ জানান।
মঙ্গলবার দিনের শুরুতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকলেও দিনভর আবহাওয়া ছিল বেশ ভালো। তীব্র গরম উপেক্ষা করে সকালের দিকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইনও চোখে পড়েছে। নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটারদের উপস্থিতিও ছিল বেশ। রাতে নগরীর বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে একের পর এক কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল। সন্ধ্যার পর থেকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামের সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন। এ সময় তাদেরকে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। এর আগেই বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ফল প্রকাশ করেন স্ব স্ব প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফলে জাহাঙ্গীর আলমের জয়ের খবরে তার নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি কর্পোরেশন গাজীপুর। এ সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার। এতে ২৫ লাখের বেশি জনসংখ্যার বসবাস। সর্বশেষ গাজীপুর সিটিতে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান ১ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। এবার এ দু’জনের কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সহসভাপতি হাসান সরকার। এ সিটিতে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলেন। তবে এখনই মেয়র পদে বসতে পারছেন না তিনি। ৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
৩১ মার্চ তফসিল ঘোষণার ৮৬ দিন পর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ভোটার ও প্রার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হল। ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণের কথা থাকলেও ৩৬ দিন নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার পর আইনি জটিলতায় মাঝপথে আটকে যায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। পরে আপিল বিভাগের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হল।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গাজীপুর সিটির উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রচার চালিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। তার বিভিন্ন পথসভায় নগরীর দুঃখ-দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে এর সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি। তারা মনে করেন, মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এখন তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পালা। এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখন সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নের পালা।
কাউন্সিলর পদে ভোটের ফল ঘোষণা আজ : রাত আড়াইটায় এ রিপোর্ট লেখাকালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের ফল পাওয়া যায়নি। মেয়র পদের ফল ঘোষণা করতে অনেক সময় লেগে যাওয়ায় কাউন্সিলর পদের ফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের বেসরকারি ফল বুধবার বেলা ১১টায় ঘোষণা করা হবে।
প্রসঙ্গত, ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন গঠিত। এর মধ্যে ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. মাজহারুল ইসলাম সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৫৬টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৫৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ পদে নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও প্রচার-প্রচারণায় দলীয় পরিচিতি বড় হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়া সংরক্ষিত ১৯টি ওয়ার্ডে ৮৪ জন নারী কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। যুগান্তর।