ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: শেষ বাঁশি বাজার পর টিভি ক্যামেরা ধরা হলো ভিআইপি গ্যালারিতে, সেখানে ডিয়াগো ম্যারাডোনা বারবার উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ছিলেন তার উত্তরসূরীদের উদ্দেশ্যে। আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল-কতটা প্রত্যাশীত ছিলো এই জয়। নাইজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নিল আর্জেন্টিনা। গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে মেসিরা দ্বিতীয় রাউন্ডে দেখা পাবে ইউরোপীয় জায়ান্ট ফ্রান্সের।
ডু অর ডাই ম্যাচ। এমন ম্যাচে যেন ভক্তদের স্নায়ুর পরীক্ষা নেয়ার পণ করে মাঠে নেমেছিলো মেসি বাহিনী। নইলে এমন দাপুটে ম্যাচ খেলেও কেন ৮৫ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা জয়সূচক গোলের। অবশেষে মার্কোস রোহ এলেন ত্রাতা হয়ে। স্বস্ত্বি নামলো আর্জেন্টাই শিবিরে।
সেন্ট পিটার্সবার্গে ‘অস্তিত্ব’ রক্ষার ম্যাচটিতে যেন শতভাগ উজাড় করে দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে খেলতেই মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। খেলার শুরু থেকেই দেখা মিলেছে আজ অন্য এক আর্জেন্টিনার, সাথে অন্য এক মেসির। যে মেসি অপ্রতিরোধ্য, যে প্রতি মূহুর্তে হানা দিয়ে পাগলপারা করে রাখে প্রতিপক্ষকে। রাশিয়ায় আজ তেমনই রূপে আবির্ভূত হয়েছে মেসি এন্ড কোং। শুধু মেসি নয়, দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের খেলায় ছিলো শতভাগ উজাড় করে দেয়ার প্রচেষ্টা, আগের দুই ম্যাচে যে আর্জেন্টিনা ছিলো নিজেদের ছায়া হয়ে, তারাই এদিন ফিরল স্বরূপে।
নাইজেরিয়ার এক খেলোয়াড়ের সাথে ধাক্কা লেগে চোখের কোনা বেয়ে দরদর করে রক্ত ধরছে হাভিয়ের ম্যাচেরানোর; কিন্তু সেসব খেয়াল করারই যেন সময় পাননি। প্রাথমিক চিকিৎসা টুকু নেয়ার কথাও যেন মনে আসেনি এই বর্ষীয়ান মিডফিল্ডারের। ম্যাচেরানো উদাহরণ মাত্র। আজ প্রতিটি আর্জেন্টাইন যেন হয়ে গেছেন ম্যাচেরানো। ফলটাও পেয়েছে হাতেনাতে।
১৪ মিনিটে মাঝমাঠের নিচ থেকে এবার বানেগার লম্বা পাস সরাসরি নাইজেরিয়ার বক্সের মাথায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন লিওনেল মেসি। উড়ে আসা বল উরু দিয়ে রিসিভ করে মাটিতে পড়ার আগে পায়ের খোঁচায় সামনে ঠেলে দেন। এরপর বলের পিছন পিছন দৌড়। পেছন থেকে তার নাগাল পাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত এক নাইজেরীয় ডিফেন্ডার, কিন্তু আজকের দিনটি হয়তো মেসির। তাই তার পক্ষে সম্ভব হলো না। দুই তিন পা দৌড়ে ছোট ডি-বক্সের মধ্যে ঢুকে ডান পায়ের জোরালো শটে গোল।
ম্যাসির এই জাদুকরী গোলে শুরুতেই এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। তবে এর আগে পরেও কয়েকটি সুযোগ পেয়েছিলো আর্জেন্টিনা। বারবার মেসি, ডি মারিয়ারা হানা দিয়েছেন নাইজেরিয়ার পোস্টে। বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক সুযোগও তৈরি করেছিলো। যদিও সেগুলো কাজে লাগেনি। তবে প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সময়ই মেসিদের ঠেকাতেই কেটেছে নাইজেরিয়া। ২৯ মিনিটে মেসির ডিফেন্স চেড়া এক পাস দৌড়ে নাগাল পাননি হিগুইন। নইলে তখনই ব্যবধানে বেড়ে যেত। ৩২ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে একা বল নিয়ে ডি মারিয়া ছুটে গোলের দিকে যাওয়ার সময় বক্সের সামান্য বাইরে ফাউল করে লিওন বালুগুন। ফ্রি-কিক পায় মেসিরা। মেসির বাম পায়ের ফ্রি-কিক সাইডবারে লেগে আরেকবার গোলবঞ্চিত আর্জেন্টিনা। এর পরের সময়টুকু শুধুই আর্জেন্টিনার।
তবে নাইজেরিয়াও দু’একবার বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করেছিলো। ১৩ মিনিটে ম্যাচেরানোর ভুলে একটি বিপজ্জনক সুযোগ তারাও তৈরি করেছিলো। কিন্তু আহমদ মুসা পোস্টে শট নেয়ার আগে ম্যাচেরানোই শেষ পর্যন্ত বল ক্লিয়ার করে বাঁচিয়েছেন দলকে। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে গেছে মেসিরা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে পাল্টে যায় খেলার সমীকরণ। নাইজেরিয়ার একটি আক্রমণের সময় ম্যাচেরানো ফাউল করেন লিওন বালুগোনকে। ৫১ মিনিটে সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন ভিক্টর মোজেস। গোল খেয়ে যেন খেলার ছন্দ হারিয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা। অন্তত পরবর্তী ১০ মিনিট তারা খুব একটা বলের দখন পায়নি। তবে ৬০ মিনিটের পর থেকে আবার নিজেদের গুছিয়ে নেয় তারা। আবার শুরু হয় আক্রমণের ধারা। ৭০ মিনিটে মেসি আরেকবার বল নিয়ে বক্সে ঢুকেও শট নিতে পারেননি।৮০ মিনিটে মেজার ক্রস থেকে পাওয়া বল বারের উপর দিয়ে মারেন হিগুইন। তবে ৮৬ মিনিটে আর ভুল করেননি মার্কোস রোহো। ডান প্রান্ত থেকে মারকাদো ক্রস ফেলেন বক্সের মধ্যে। অনেকটা দৌড়ে এসে উড়ন্ত বলে ভলি শট নেন রোহ….. গোল! পরের কয়েকটা মিনিট আর লিড ধরে রাখতে সমস্যা হয়নি মেসি বাহিনীর।
তবে জয়সূচক গোল করার আগে কয়েকটি আক্রমণ করেছিলো নাইজেরিয়া। ৮২ মিনিটে খুব কাছ থেকে ইগালোর শট আর্জেন্টাইন গোলরক্ষকের হাঁটুতে লেগে রক্ষা। ইনজুরি সময়েও আরেটি বিপজ্জনক আক্রমণ ছিলো আফ্রিকার দলটির। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হলো প্রথম রাউন্ডেই।
আর্জেন্টিনা পৌছে গেল দ্বিতীয় রাউন্ডে। গ্রুপের অপর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কাছে আইসল্যান্ড ২-১ গোলে হেরে যাওয়ায় মেসিরা ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপে দ্বিতীয় হয়েছে।