বিবিসির চোখে: কেমন হলো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

ক্রাইমবার্তা রিপোট:   ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক কাদির কল্লোল একটি সরেজমিন প্রতিবেদন করেন। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

বুধবার সকালে গাজীপুরে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ফলাফল নেয়ার সময় শত শত সমর্থক বেষ্টিত মি: আলম ছিলেন উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, ভোটারদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী মি: আলম দুই লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন বিরোধীদল বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে । কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে তাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এবং প্রশ্নগুলো সহসা তার পিছু ছাড়বে না।

জাহাঙ্গীর আলমের সাথে আমি যখন কথা বলছিলাম, তার বক্তব্য ছিল, “আপনারা অনেক প্রশ্ন তুলছেন। একটা বড় নির্বাচন হলে কিছু অনিয়ম হয়। এই নির্বাচনেও কিছু অনিয়ম হয়েছে বলেই নির্বাচন কমিশন নয়টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করেছে। কিন্তু সেটা পুরো নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে পারে না। এখানে নির্বাচন শতভাগই সুষ্ঠু হয়েছে।”

কিন্তু তার এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল কতটা?
ভোটের দিনে অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় আমি টঙ্গী বাজারের কাছে গাছা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখি ভোটারের দীর্ঘ সারি। অনেক নারী পুরুষ। কেন্দ্রের চত্বরে পরিবেশও ছিল বেশ ভাল। কিন্তু কেন্দ্রের ভেতরে বুথগুলোতে গিয়ে দেখা যায় – বিএনপির মেয়র প্রার্থীর কোনো এজেন্ট নেই। প্রশ্ন তুললে অন্য এজেন্টরা আমাকে জবাব দিলেন, “তারা বাথরুমে গেছেন, এখনই চলে আসবেন।” ঘন্টাখানেক ঐ কেন্দ্রে ছিলাম, সেই সময়েও বিএনপির এজেন্টরা বাথরুম থেকে ফিরে আসেননি। অল্প দূরত্বেই আরেকটি ভোটকেন্দ্র কলেমেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।

তবে ঐ কেন্দ্রটিতে বাড়তি একটা দৃশ্য চোখে পড়ে, তাহলো কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভিড়। তারা তাদের প্রতীকের ব্যাজ লাগিয়ে তাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে এবং বাইরে সক্রিয় রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে কেন্দ্রের ভিতরে গিয়েও ঘুরে আসছেন। কেন্দ্রের চত্বর এবং ভেতর যে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল, তা বুঝতে কষ্ট হয়নি।

টঙ্গী এবং গাজীপুরের দশটি ভোটকেন্দ্র আমি ঘুরেছি। তার মাত্র একটি কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট পেয়েছিলাম। সেই এজেন্টকেও তার প্রার্থীর ব্যাজ বা পরিচয়পত্র লাগাতে দেখা যায়নি। তিনি জানান, ভয়ে কোনো ব্যাজ ব্যবহার করছেন না।

গাজীপুর মোড়ে জটলা করে থাকা কিছু লোকজনের সাথে আমি কথা তারা নিজেদের বিএনপি মেয়র প্রার্থীর সমর্থক বলে পরিচয় দিলেন। তাদেরও বক্তব্য ছিল, ভয়ে তারা তাদের প্রার্থীর ব্যাজ লাগাননি।

আমি যে ক’টি কেন্দ্র দেখেছি, বেশিরভাগ কেন্দ্রেই বাইরে এবং ভিতরে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

ভোটারদের দীর্ঘ সারি
সকালের দিকে অধিকাংশ কেন্দ্রেই ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। তাদের অনেকে বলেছেন, অনেকদিন পর নিজের ভোট দিয়ে তারা আনন্দিত। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে এবং ভিতরে ছিল আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ।

এরমধ্যেই কোনাবাড়ি এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একজন যুবকের দেখা মেলে। তিনি নৌকার ব্যাজ পরে এসে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। এই যুবক আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে তার ভোট দেয়ার গল্পটি বলে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়েন।

চারশ’ পঁচিশটি কেন্দ্রের মধ্যে আমি দশটি কেন্দ্র ঘুরেছি। একে নির্বাচনের সার্বিক চিত্র হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু ঢাকার যেসব সাংবাদিক এই নির্বাচন দেখতে গিয়েছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতাও ছিল কমবেশি আমার মতই।

ভোট শেষে একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, “ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি এবং দৃশ্যমান পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় ছিলনা কোথাও কিছু সমস্যা ছিল।”

ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল
বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ একটি কেন্দ্র থেকে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আমাকে ফোন করে বললেন, “আপনি কোথায়, এই কেন্দ্রে সিল মারছে দ্রুত আসেন।” তিনি আমার মোবাইল ফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন, তা আর জানা হয়নি।

দ্রুত সেই এম এ আরিফ কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, নৌকা মার্কার ব্যাজ লাগানো কয়েকজন যুবক বুথ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তবে তাদের সিল মারা দু’একটি ব্যালটের প্রমাণ সেখানে রয়ে যায়।

কেন্দ্রের একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট অভিযোগ করলেন, ঐ যুবকরা বুথের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কক্ষে গিয়ে নৌকা মার্কায় এবং আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরেছে। সেখানে বাইরে তখনও ভোটারের সারি। এক ঘণ্টা ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকার পর আবার ভোটাররা ভোট দিতে পারেন। এই কেন্দ্রের সাথেই একটি প্রাইমারি স্কুলের বুথেও একই অভিযোগ পাওয় যায়। অবশ্য নির্বাচন কমিশন পরে এই দু’টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে।

গাজীপুর শহরে মদিনাতুল উলুম আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে ভোটার উপস্থিতি দেখে পরিবেশ দেখে ভালই মনে হয়েছিল। কিন্তু এই কেন্দ্রের তিনতলায় গিয়ে দেখা যায়, দুই তিনজন যুবক প্রকাশ্যে নৌকা মার্কায় সিল মেরে সেই ব্যালট বাক্সে ভরছেন। বিবিসির সারোয়ার হোসেন ক্যামেরা তাক করার সাথে সাথে তারা দ্রুত কাজ সেরে সরে পড়েন। সবার সামনে এমন ঘটনা অবাক করার মতো। ঐ কেন্দ্রে সবকটি বুথে একই ঘটনা ঘটে।

এমন পরিস্থিতিতে সেখানে ভোট বন্ধ থাকার অনেকটা সময় পর আবার ভোট নেয়া হয়। মাদ্রাসাটিতে চারটি কেন্দ্র ছিল। একটির ভোট পরে বাতিল করা হয়। ভোটের পরে গাজীপুরের রাস্তায় কয়েকজন ভোটারের সাথে কথা বলি।

তাদের একজন বলছিলেন, “বড় মারামারি বা কাটাকাটি নাই। তারপরও এই নির্বাচন নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে… কৌশলে খেলা হয়েছে।” তবে সেখানে কথায় কথায় বেসরকারি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করলেন, নির্বাচন কী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছে?

আপনার কী মনে হয়? আমার পাল্টা প্রশ্নে ঐ শিক্ষকই বললেন – ধরপাকড়ের ভয়ে বিএনপি নেতা-কর্মিরা মাঠে ছিল না। ভোটের দিনও তারা সংগঠিত এবং সক্রিয় ছিল না। ফলে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দিয়ে অংশ নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না বলে তিনি মনে করেন।

Check Also

তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন

তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।