ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন এবং অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
আগামীকাল রোববার থেকে এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান।
তিনি শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সংবাদ সম্মেলনে বাধা ও হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং সারা দেশে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে।
এর আগে বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল্লাহ নূরসহ সাতজন আহত হন।
আহত অন্যরা হলেন- আরশ (২৬), আব্দুল্লাহ (২৩), আতাউল্লাহ (২৫), সাদ্দাম হোসেন (২৫), সাহেদ (২৫) এবং হায়দার।
আহতরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জানা গেছে, শনিবার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আন্দোলনকারীরা জড়ো হন।
এ সময় ছাত্রলীগ ও সরকারি দলের লোকেরা সশস্ত্র হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে উপস্থিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এ সময় মুখোমুখি অবস্থান নেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এ সময় আন্দোলনকারীদের পাঁচ–ছয়জনকে মারধর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
হামলার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কাউকে দেখা যায়নি। তবে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান জানান, বেলা ১১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর পিস্তল ও রামদা নিয়ে হামলা চালায়। আমাদের অগণিত কর্মী আহত হয়েছে। আমরা তাদের কাছে এটা প্রত্যাশা করিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ডিউটি অফিসার এসআই মো. হাবিব যুগান্তরকে বলেন, হামলার বিষয়ে বলতে পারব না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলে সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়ন না করায় শনিবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন ডাকে কোটা আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
এ সংবাদ সম্মেলন থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে ফাইনাল আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা ছিল।
শুক্রবার দুপুরে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান শনিবারের সংবাদ সম্মেলন ডাকার কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলন প্রতিহত করতে বিভিন্ন মহল ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ করে এতে শিক্ষার্থীদের দলবেঁধে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জানা গেছে, কোটাপ্রথা বাতিলে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি।
গত ১৪-২০ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কর্মসূচি পালিত হয়। পরে রমজান মাসের কারণে কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন।
ওই সময় বলা হয়েছিল, কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে ঈদের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এর জন্য ঈদের পর থেকে ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যমে প্রচারেও চলছিল।
এর মধ্যে গত বুধবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা থাকবে বলে ইঙ্গিত দেন।
কোটাপ্রথা বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সব দিক বিবেচনা করে চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চালু করি। কিন্তু যারা এই কোটার সুবিধাভোগী, তারাই তা চাইল না। এমনকি মেয়েরা বলছেন, তারাও কোটা চায় না। আমি বলেছি- তারা যখন চায় না, তখন কোটার দরকার নেই। এ বিষয়ে কেবিনেট সেক্রেটারিকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। বলেছি- কোটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা তিনি ঠিক করবেন। এর পর যদি মফস্বলের কেউ চাকরি না পায়, তা হলে আমাদের দায়ী করতে পারবে না। তবে এখানে বিরোধী দলের নেত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের সাপোর্ট করে বললেন- আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য রয়েছে। তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। সে জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা থাকবে বলেও ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, গত ৮ এপ্রিল থেকে চার দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন।
পর দিন সচিবালয়ে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন আন্দোলনকারীরা।
বৈঠক শেষে মন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের বলেছি- আগামী ৭ মের মধ্যে সরকার বিদ্যমান কোটার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। সেই পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত থাকবে।
এ সময় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনও ৭ মে পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন।
এ ঘোষণার পর ৯ এপ্রিল রাতে আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায়। তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর এক বক্তব্য কেন্দ্র করে ১০ এপ্রিল থেকে ফের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা সংস্কারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত আসার দাবি জানান।
পরে ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কোটাপদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করে সব চাকরিতে শতভাগ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর দিন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল বের করেন।
এর দুই সপ্তাহ পর গত ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি জানান আন্দোলনকারীরা। না হলে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন তারা।
পর দিন ২৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল।
গত ২ মে সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা বাতিলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো ধরনের ক্ষোভ থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ছাত্ররা কোটাব্যবস্থা বাতিল চেয়েছে, বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
এর পর গত ৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছিলেন, সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল বা সংস্কারের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
তার এ বক্তব্যের পর গত ৯ মে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
এ সময় তারা ঘোষণা দেন ১০ মের মধ্যে কোটা সংস্কারে প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে সারা দেশে সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠোর আন্দোলন শুরু হবে।
এর পর প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ মে সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
সর্বশেষ ২০ মে কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।