ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে লিওনেল মেসির বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা পরই বিশ্বকাপ মিশন শেষ হলো ফুটবল বিশ্বের আরেক মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। একই দিনে দুই লিজেন্ডের বিদায়। সময়ের ব্যবধান মাত্র চার ঘণ্টা। কাজানে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি আর সোচিতে উরুগুয়ের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিয়েছেন পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ক্লাব ফুটবলের দুই মহারথীর বিদায়ে মন ভেঙেছে ভক্তকুলের।
এডিসন কাভানির জোড়া গোলে দ্বিতীয় রাউন্ডে শনিবারের দ্বিতীয় ম্যাচে পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়েছে উরুগুয়ে। এর ফলে লুইস সুয়ারেজ, এডিসন কাভানিরা পৌছে গেল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে তারা আগামী শুক্রবার মোকাবেলা করবে ফ্রান্সকে।
ইরানের বিরুদ্বে ম্যাচের একাদশে তিনটি পরিবর্তন নিয়ে এদিন মাঠে নামে পর্তুগাল। পর্তুগাল দল তাকিয়ে ছিল রোনালদোর দিকে। গ্রুপপর্বে হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করা রোনালদো ছিল জ্বলে উঠার অপেক্ষায়। বিশ্বকাপ ও ইউরো মিলে ৩৮তম ম্যাচ খেলতে নামলেন তিনি। এমন কীর্তি আছে কেবল বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগারের। তিনিও দুই আসর মিলে ৩৮ ম্যাচ খেলেছেন। এমন ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখতে গোলের অপেক্ষায় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও উরুগুয়ের রক্ষণভাগের দৃঢ়তায় কোনো গোলের দেখা পাননি রোনালদো।
এই ম্যাচে শুরুতেই গোল করে এগিয়ে যায় লাতিন আমেরিকার দলটি। মাত্র ৭ মিনিটে উরুগুয়েকে লিড এনে দেন স্ট্রাইকার এডিসন কাভানি। পর্তুগালের ডি বক্সের বাইরে বল পেয়ে ডানদিকে লুইস সুয়ারেজকে ভলিতে বল দেন কাভানি। এরপর দৌড়ে পর্তুগালের বক্সে প্রবেশ করেন। সুয়ারেজ নিখুঁত করলে হেডে জালে জড়ান কাভানি।
গোল খাওয়ার পর আক্রমণের ধার বাড়ে পর্তুগালের। তবে উরুগুয়ের ডিফেন্স তাদের কোন সুযোগ দেয়নি প্রথমার্ধে। উরুগুয়েই সুযোগ পেলেই কাউন্টার অ্যাটাকে কাঁপন ধরিয়েছে পর্তুগালের ডিফেন্সে। দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটে পেপের হেডে সমতায় ফেরে পর্তুগাল। শর্ট কর্নার থেকে পাওয়া বলে রাফায়েল গুরেইরোর ক্রসে লাফিয়ে উঠে হেড করেন পর্তুগালের সেন্টার ব্যাক পেপে। তবে সমতায় ফিরেও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে পর্তুগিজরা।
৬২ মিনিটে আবার উরুগুয়েকে লিড এনে দেন কাভানি। কাউন্টার অ্যাটক থেকে গোল পায় দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা। মধ্যমাঠের নিচ থেকে মুসলেরার লম্বা পাস আসে বেনতাঙ্কুর কাছে। ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে পর্তুগালের ডি-বক্সের দিকে দৌড় দেন বেনতাঙ্কুর। এর মধ্যে বাম প্রান্তে আগুয়ান কাভানিকে দেখতে পেয়ে তার উদ্দেশ্যে পাস দেন।
কাভানি তিনি চলন্ত বলেই বাম পায়ে কোনাকুনি শটে বল পাঠান জালে। কিপার প্যাট্রিসিও ঝাঁপিয়ে পড়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি (২-১)।
শেষ সময়ে বেশ কিছু আক্রমণ করেও আর গোল শোধ করতে পারেনি পর্তুগাল। এই ম্যাচে পরাজয়ের ফলে আর্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসির পর বিশ্বকাপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম দিনেই বিদায় হলো ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর।
আরো পড়ুন : যে দুটি কারণে হারল আর্জেন্টিনা
দুর্বল ডিফেন্স আর ফরাসিদের দুর্দান্ত গতির কাছেই হার মেনে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল আর্জেন্টিনা। এমন ছন্নছাড়া ডিফেন্স নিয়ে বিশ্বকাপের মতো আসরে জয় পাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। আর প্রতিপক্ষ যখন ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় জায়ান্ট। গতিই যাদের খেলার মূল অস্ত্র।
বল দখলের লড়াই কিংবা ভয়ঙ্কর আক্রমণ নয়, রাশিয়ার কাজানে শনিবার ফরাসিদের গতির কাছেই হার মানতে হলো আর্জেন্টিনাকে। কাউন্টার অ্যাটাকে আর্জেন্টিনাকে পাগলপারা করেছে এদিন ফরাসিরা। আক্রমণ নয়, যেন কতক্ষণ পর পর পারমাণবিক সাবমেরিন ধেয়ে এসেছে আর্জেন্টিনার গোল পোস্টের দিকে। আর সেই গতির তোড়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়েছে আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডাররা। প্রতিটি আক্রমণ কাঁপিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। তাই তো এক পর্যায়ে ২-১ গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৪-৩ গোলের ব্যবধানে হারতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে।
পুরো ম্যাচে বল দখলে এগিয়ে ছিলো লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে ৬৪ শতাংশ বল দখলে ছিলো তাদের, আর পুরো ম্যাচ মিলে ৫৯ শতাংশ; কিন্তু তারা কার্যকর আক্রমণ করতে পেরেছেন খুবই কম। বরং উল্টো বারবার কাউন্টার অ্যাটাক করে আর্জেন্টিনা শিবিরে ভীতি ছড়িয়েছে ফ্রান্স।
আর্জেন্টাইনরা নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে আক্রমণে যায় বারবার; কিন্তু ফ্রান্সের দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেঙে তারা ডি-বক্সে ঢুকতে পেরেছে খুব কমই। আক্রমণে আর্জেন্টিনা কতটা পিছিয়ে ছিলো তার প্রমাণ ৪১ মিনিটে ডি মারিয়া যে গোল করেছেন, সেটিই ছিলো বারপোস্ট লক্ষ্য করে আর্জেন্টিনার প্রথম শট। তাও বক্সের অনেক বাইরে থেকে দুরপাল্লার শটে।
কিন্তু ফ্রান্স বেশ কয়েকবার ভয়ঙ্কর সব কাউন্টার অ্যাটাক করেছেন। নিজেদের সীমান্তে বল পেলেও তারা দ্রুত লম্বা পাস দিয়েছেন স্ট্রাইকার এমবাপ্পে বা গ্রিয়েজম্যানকে। কখনো এমবাপ্পে,কখনো গ্রিয়েজম্যান, কখনো পগবা ধেয়ে গেছেন আর্জেন্টিনার ডি বক্সে। দ্রুত গতির এই তিন তারকার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডাররা। ১১ মিনিটে এমনি একটি আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে এমবাপ্পেকে ফাউল করেন মার্কোস রোহো। পেনাল্টি পায় এবং গোল করে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। পুরো প্রথমার্ধে ফ্রান্স একটি মাত্র গোছানো আক্রমণ করেছে(৩৯ মিনিটে)। তাদের বাকি সবটুকুই ছিলো কাউন্টার অ্যাটাক শো।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কিছুটা গোছানো আক্রমণ করেছে মেসিরা। ফলও পেয়েছে ৪৮ মিনিটে মেসির শট মারকাডোর পায়ে লেগে জালে জড়ায়(২-১)। গোল করার পর কিছুটা রক্ষণাত্মক খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। এই সুযোগে তাদের চেপে ধরে ফ্রান্স। ৫৭ মিনিটে পাভারের সমতাসূচক গোলের পর ফরাসিদের তরুণ সেনা এমবাপ্পের জোড়া গোল(৪-২)। তার মধ্যে ৬৮ মিনিটের জোড়া গোলটি তো কাউন্টার অ্যাটাকের সামনে আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারদের অসহায়ত্বের গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।
গোল খেয়ে যতটা আগ্রাসী হয়ে ওঠার কথা ছিলো মেসিদের তার ছিটেফোটাও দেখা যায়নি। এক ডি মারিয়া বামপ্রান্ত দিয়ে কিছু আক্রমণ করেছেন, এছাড়া ফ্রান্সকে বিপদে ফেলার মতো কিছু করতে পারেনি তারা। বক্সের মধ্যে বারবার ক্রস ফেলা হলেও সেগুলোতে ফিনিশিং করার মতো কেউ ছিলো না। কখনো কেউ থাকলেও ফরাসি ডিফেন্ডারদের কাছে তারা পাত্তা পায়নি। এর মধ্যে কয়েকটি ভালো সুযোগও নষ্ট হয়েছে। ৮৫ মিনিটে মেসি বক্সের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে বল নিয়ে ঢুকেও শট নিতে পারেননি। পাভোন কয়েকটি ভালো বল পেলেও সেগুলো কাজে লাগাতে পারননি। কিছু ভুল পাস দিয়েছেন মেসিও। ৮৬ মিনিটে মেসির একটি দারুণ পাসে আগুয়েরো টোকা দিতে পারলে আরেকটি গোল পেতে পারতো তারা। শেষ মূহুর্তে(৯০+৩) আগুয়েরো যখন গোল করলেন, ততক্ষণে সময় শেষ।
এই ম্যাচে ফ্রান্সের গোল সংখ্যা আরো বেশি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। ৭ মিনিটে এমবাপ্পেকে বক্সের সামান্য বাইরে ফাউল করেন হাভিয়ের ম্যাচেরানো। ফি-কিক থেকে গ্রিয়েজম্যানেরট শট ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। ৫৬ মিনিটে ডিফেন্ডার ফাসিওর ভুলে প্রায় গোল করে ফেলেছিলেন গ্রিয়েজম্যান। যে কাউন্টার অ্যাটাকগুলোতে ফ্রান্স গোল করতে পারেনি তা যতটা আর্জেন্টিনার সফলতা তার চেয়েও বেশী ফরাসিদের ভুল