আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় নার্সারী করে স্বালম্বী হচ্ছে হাজারো মানুষ। প্রতিবছর কয়েক লক্ষ বৃক্ষের চারা এ জেলা থেকে সরবরাহ করা হয়। এ জেলায় উৎপাদিত নার্সারীর কদর সারাদেশে । জেলায় ২০৪ জন পেশাদার বৃক্ষ প্রেমিকী সারা বছরই ফলদ, বনজ, ভেষজ, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা উৎপাদন করে থাকে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এখানকার উৎপাদিত নার্সারী কোটি টাকা বেচা-কেনা হয়ে থাকে বলে নার্সারী মালিকরা জানান। জেলার ঝাওডাঙ্গা,কলারোয়া,পারুলিয়া,পাটকেলঘাটা,ভোমরা সহ বিভিন্ন হাটে বাজারে কলম বেচা কেনার ধুম পড়ে গেছে। জেলার বাইরে থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা এখন সাতক্ষীরাতে কলম কিনতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
ছায়া, বাতাস, জ্বালানী, আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি তৈরী, পুষ্টি ও খাদ্যের প্রয়োজনে মানুষ বসতবাড়ির আশে পাশে রোপণ করছে প্রচুর ফলজ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের চারা। যত দিন যাচ্ছে উদ্যান উদ্ভিদের চারার চাহিদা ততই বাড়ছে। জেলাতে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য মান সম্মত নার্সারী। অর্থনীতি ও পরিবেশ রক্ষায় নার্সারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও এ খাতকে এখনো দেওয়া হয়নি শিল্পের মর্যাদা । এর উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য নেয়া হয়নি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা। নেই এ শিল্পের দক্ষ জনশক্তি গড়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। ফলে সুবিধা বঞ্চিত এ পেশায় সংশ্লিষ্টরা।
জি.এম আব্দুল্লাহ। ছোট বেলা থেকেই নার্সারী করে আসছে। বর্তমানে ১৫ বিঘা জমিতে তার বিভিন্ন ধরণে নার্সারী। প্রায় দুই লক্ষ গাছের চারা তার নার্সারীতে। শহরের টিবি হাসপাতাল সংলগ্ন মিয়াসাহের ডাঙ্গীতে তার বেশির ভাগ নার্সারী। মায়া কানান তার নার্সারীর নাম। ২০১০ সালে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছ থেকে নার্সারীতে পুরুষ্কার গ্রহণ করেন। এছাড়া জেলা উপ
জেলা সহ বিভিন্ন মেলাতে তিন প্রথম স্থান অধীকার করেন। প্রতি বছর তিন লক্ষ টাকা খরচ করে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার গাছের চারা তিনি বিক্রি করেন। এ বছর তার ক্ষেতে মাল্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিটা গাছে মাল্টা ধরে গাছ নুয়ে পড়েছে। জাম,জামরুল,পেয়ারা,লেপু,জলপাই,লিচু সহ বিভিন্ন জাতের ফলদ, বনজ, ভেষজ, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছে লক্ষাধীক কলম বেধেঁছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়াতে এবছর তিনি ক্ষতির আশঙ্কা করছে।
সরকারী ভাবে নার্সারীর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও জেলা নার্সারী মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল আমিন জানান, তাদের সমিতিতে ২০৪ জন নার্সারী মালিক রয়েছে। তিনি জানালেন,এক সময়ে এ পেশায় ব্যাপক লাভ হত কিন্তু বর্তমানে কোন রকমে খরচটা উঠে। সরকারী ভাবে তদারকী বৃদ্ধি ও নার্সারী মালিকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করলে এ খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
জেলাতে পাঁকা বাড়ির ছাদে নার্সারীর আবাদ শুরু হয়েছে। দিন দিন এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠের লাবসা এলাকায় চোখ জুড়ানো এ বাড়ির ছাদে বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শেখ মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রী শাহিনা আক্তার এটি গড়ে তুলেছে। এই দম্পতি তাদের তিন হাজার দুইশ বর্গফুট বাড়ির ছাদে কয়েকশ গাছগাছালির একটি বাগান গড়ে তুলেছেন।
তার ছাদে দেশি-বিদেশি ফুল, ফল, সবজি ও ঔষধিগাছ লাগিয়েছেন।
শেখ মনিরুজ্জামান-শাহিনা দম্পতি জানালেন, বাড়ির ছাদে বাগান করা খুব একটা কঠিন কাজ না। ইচ্ছে করলে যে কেউই ছাদে ফলমূল, শাকসবজির বাগান তৈরি করতে পারেন। এতে করে শাকসবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কোনও পরিবার আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হতে পারে। পাশাপাশি অক্সিজেনও দেয় এসব গাছগাছালি।
শাহিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হলেও সেই ছোটবেলা থেকে তিনি
গাছ লাগাতেন। আমি স্কুলের
টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে বাবার বাড়িতে বাগান করতাম। শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখি স্বামীরও বাগান করার শখ। দুই বৃক্ষ প্রেমিক মিলে শুরু করে দিলাম গাছ লাগানো।’
সাতক্ষীরার অর্থনীতিতে ও পরিবেশ সংরক্ষণে নার্সারীর গুরুত্ব অপরিসীম। নার্সারী হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফুল, ফল, সবজি, ভেষজ ও বনজ গাছের চারা ও কলম উৎপাদন করে বিক্রি বা বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে নার্সারী শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। ১৯৭৪ সালের দিকে সাতক্ষীরায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নার্সারী ব্যবসা চালু করা হয়। নব্বই দশকের শুরুতে এখানে হাতে গোণা কয়েকটি নার্সারী ছিল। বর্তমানে ছোট বড় মিলে প্রায় চার শতাধীক নার্সারী রয়েছে। নার্সারী মালিক সমিতির সূত্রে জানা যায়, জেলাতে এখাতে ৫শ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নার্সারী ব্যবসার সাথে জড়িত। গত এক দশক ধরে সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বনবিভাগের নার্সারী ছাড়াও বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নার্সারী স্থাপনের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এজন্য নার্সারী উদ্যোক্তাদের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ,বনবিভাগ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দেয়া হচ্ছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। নার্সারী ব্যবসার সাথে পরিবেশ, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত রয়েছে। নার্সারী ব্যবসা করে জেলার বহু ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল ও সক্রিয় রাখতে এ খাত নতুন নতুন কর্মসংস্থান উদ্যোগতা সৃষ্টি করেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান জানান,নার্সারী খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের কৃষি বিভাগ, বন বিভাগ সহ বিভিন্ন মন্ত্রনালয় চাষীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন ধরণে উদ্যোগ নিয়েছে। সাতক্ষীরায় নার্সারী মালিকদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে খোজ খবর নেয়া সহ বিভিন পরামর্শ দেয়া হয়।